Friday, August 31, 2007

মৃত্তিকা বুলেটিন ক্রম: ০১; বর্ষ ক্রম:০২




মৃত্তিকা
জাতিতাত্ত্বিক লোকায়ত জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ
বর্ষক্রম:০২,বুলেটিন ক্রম:০১
বীর শহীদ পীরেন স্নালের মহান আত্মত্যাগের এক বছরে বিশেষ পত্র
প্রকাশকাল: ২০ পৌষ ১৪১১ বঙ্গাব্দ, ৩ জানুয়ারি ২০০৫ খৃষ্টাব্দ।।৩৪৭ শহীদ সালাম বরকত হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা থেকে প্রকাশিত।। বিনিময়: ২ টাকা
সম্পাদনা:জুয়েল বিন জহির, পরাগ রিছিল, দুপুর মিত্র; সহযোদ্ধা: শারমিন শর্মী, জাহানারা খাতুন সীমা, তাসলিমা আক্তার রোমন।

বীর শহীদ পীরেন স্নালের রক্ত বলে যায় নিরন্তর সংগ্রামের কথা



১.শালবন কোচ,বর্মণ, মান্দি জাতির হা.বিমা...

টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একসময় ছিল শালবনে আচ্ছাদিত মধুপুর গড় এলাকা। এই শালবনে হাজার হাজার বছর ধরে মান্দি, কোচ, বর্মণ প্রভৃতি জাতিসত্ত্বার লোকজন বসবাস করে আসছে। এই শালবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তাদের বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় জীবনাচার। শালবন মান্দি জাতির হা.বিমা। এই হা.বিমা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র। বলশাল ব্রিং এর নানান প্রজাতির গাছপালা-তরুলতা, পশুপাখি সব কিছুর সাথেই গড়ে উঠেছে তাদের অকৃত্রিম সখ্যতা। কেননা মান্দিরা বিশ্বাস করে যে, এই ব্রিং এর যত গাছ-পালা, পশু-পাখি সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে মিদ্দি বাগবা-র পবিত্র চিপাংফাক্‌ছা থেকে। একসময় শালবনের ভিতরে নিজস্ব রীতিতে হাবাহু.আ-র মাধ্যমে ঘরে তুলত নানান ফসলাদি। কোন অভাব অনটন তেমন ছিল না। শালবনে বিচরনের ক্ষেত্রে বা ফল-মূল সংগ্রহ বা হাবাহু.আ-র জন্য কারো কাছে কোন অনুমতির প্রয়োজন পড়ত না। কেউ একবার কোন জংলা জমি পরিস্কার করে যদি জুম আবাদ শুরু করত তাতেই ঐ জমির উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত। অন্য কেউ তখন আর ঐ জমির উপর নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনরূপ চেষ্টা করত না। এটাই ছিল সমাজের নিয়ম, যা বংশপরম্পরায় চলে আসছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কিন্তু এরপর একে একে পাল্টাতে থাকে শালবনের উপর আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারের ধরন-ধারন। ব্রিটিশ জমিদারি প্রথার মাধ্যমে মধুপুর গড় নাটোরের রাজার অধীনে আসে। নাটোরের রাজার শাসনাধীন হওয়ার পর মান্দিরা শালবনের নিচু জমি নিজেদের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিতে এবং উঁচু জমিতে লীজের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে পারতো। ১৮৭৮ সালে ধানী জমি ভারতীয় প্রজাসত্ত্ব আইনে নথিভুক্ত করা হয় যার আওতায় বছর বছর তারা নিয়মিত কর প্রদান করে থাকে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় নানান প্রকল্প-প্রক্রিয়ায় শালবনেরই সন্তান মান্দি, কোচ, বর্মণদের উচ্ছেদ করার নিত্য নতুন আয়োজন। আর এইসব আয়োজন-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মান্দি, কোচ, বর্মণেরা লড়ে গেছেন অসীম সাহসিকতায়। নিজ জননী ভূমিকে রক্ষার জন্য সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই রচনা করে চলেছিল একের পর এক প্রতিরোধের। আর এই প্রতিরোধ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ৩ জানুয়ারি গায়রা গ্রামে বহু যুগের নির্যাতন-নিপীড়নের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ তাদেরকে দাঁড় করিয়েছিলো ইকোপার্কের নামে হা.বিমাকে দেয়াল দিয়ে ঘেরার প্রতিবাদ জানাতে।খা সাংমা,খা মারাক-ধ্বনিতে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে, জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মান্দি, কোচ, বর্মণ জাতিসত্ত্বার লোকজন। নিজেদের অধিকার এবং নিজ হা.বিমার সম্মান কে অক্ষুণ্ন রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সমবেত হয়েছিল দেয়াল নির্মাণ রুখে দিতে। সেদিন হাজার হাজার আদিবাসীর বিপ্ল­বী চেতনাকে ম্ল­ান করে দিতে বনরক্ষী ও সরকারি পেটোয়া বাহিনী পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন পীরেন স্নাল; আহত হয়েছিলেন উৎপল নকরেক, এপিল সিমসাং, শ্যামল চিরান ও রীতা নকরেক সহ আরো অনেকেই। এই যে পীরেন স্নালের মৃত্যু বা আরো অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা, তা কোন ভাবেই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শালবনের আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ও শালবনকে ধ্বংস করার জন্য বন বিভাগ বা শাসক গোষ্ঠীর ধারাবাহিক অমানবিক, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের একটা অংশমাত্র।


২.শালবন ধ্বংস এবং আদিবাসী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নাম ফরেস্ট এ্যাক্ট, রিজার্ভ ফরেস্ট, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্প,তুঁত চাষ, ফায়ারিং রেঞ্জ...

যুগ যুগ ধরে শালবনে বসবাসরত কোচ, মান্দিদের কখনো বনের উপর মালিকানা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়েনি। অন্যভাবে বলা যায় যে, মালিকানা শব্দটির অর্থই ছিল তাদের কাছে অজ্ঞাত। যে শালবনে তাদের জন্ম, বেড়ে উঠা, বনকে ঘিরেই যাদের ধর্ম, আচার, সংস্কৃতি তার আবার মালিকানা কীসের। তারাতো বনের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন কাজ কখনো করেনি। বন থেকে যখন থারেং, থা.মান্দি সংগ্রহ করতো তখনতো তারা পুরো গাছটাকেই উপড়ে তুলে ফেলত না; বরং কাঙিখত আলু বা কচু সংগ্রহের পর সেই গাছটি আবার সযত্নে মাটিতে পুঁতে দিতো। বিভিন্ন আমুয়া(পূজো) বা অন্যান্য কাজে যখন ফুল-ফল, লতা-পাতার প্রয়োজন পড়তো তখনতো জঙ্গলের বা গাছের কাছে অনুমতি না নিয়ে তারা একটা জিনিসেও হাত দিতো না। তারাতো বন থেকে কোন জিনিস অবাধে লুটে-পুটে নিয়ে কখনো বাইরে পাচার করেনি। বরং বনের জীববৈচিত্র্য যাতে অক্ষুন্ন থাকে এজন্য মান্দিরা প্রতিবছর বর্ষাকালে পালন করতো আসংদেনা আমুয়া। আমুয়ার দিন খামালের (পুরোহিতের) পিছনে পিছনে সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করে একটা জায়গায় পূজোর কৃত্যাদি সম্পন্ন করার পর সেখানে সবাই মিলে রোপন করতো নতুন গাছের চারা। এভাবেই নানান নিজস্ব রীতি-নীতিতে তারা বনকে, বনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে আসছিল যুগ যুগ ধরে। বনকে ধ্বংস তো দুরে থাক, বনের সামান্যতম ক্ষতি করাকেও তারা মারাং বা দূষণীয় জ্ঞান করতো। এইছিলো শালবন কে ঘিরে কোচ, মান্দি, বর্মণদের ধ্যান-ধারনা বা বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের বিপরীতেই পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় সরকারের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে মধুপুর শালবনের উপর। ১৯৪৯ সালের `East Pakistan Private Forest Act’(Act of 1950) এবং ১৯৫০ সালের `East Pakistan State Acquisition and Tendency Act’ এর অধীনে ‘রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার মাধ্যমে শালবনকে দখল করা হয়। এরপর বনবিভাগ কর্তৃক শুরু হয় কোচ,মান্দি, বর্মণদের উপর একের পর এক উচ্ছেদ নোটিশ, জবরদখল, লুটপাট, মিথ্যামামলার নানাবিধ খড়গ।

ভারতীয় প্রজাসত্ত্ব আইন রদ এবং এই আইনের আওতাধীন আদিবাসীদের রেজিষ্ট্রিকৃত জমি বাজেয়াপ্ত করার প্রচেষ্টাসহ ১৯৫৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বন সেটেলমেন্ট অফিসার এস. এইচ. কোরেশী উচ্ছেদ নোটিশের ইশতেহার প্রকাশ করেন।

১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর আজম খান মধুপুর বনে ৪০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য ঘোষণা করে এবং এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রায় ২১ হাজার একর এলাকায় যেখানে হাজার হাজার মান্দিরা বসবাস করছে সেখানে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।

১৯৬৮ সালে গভর্ণর ও বনমন্ত্রী কোন রকম ক্ষতিপূরণের আশ্বাস ব্যতিরেকেই চুনিয়া গ্রামের মান্দিদের প্রথম উচ্ছেদ নোটিশ এবং ১৯৬৯ সালে জাতীয় উদ্যান প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চুনিয়া গ্রামে দ্বিতীয় উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে।

১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে শালবনের বাসিন্দারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র, লড়েছিল জীবন বাজি রেখে। শহীদ হয়েছিলেন অনেক আদিবাসী নারী-পুুরুষ। কিন্তু স্বাধীসতা সংগ্রামের পরেও শালবনের আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় আচরনের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। বনের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী আমলের সমস্ত কালাকানুনই থেকে যায় অপরিবর্তিত। ১৯২৭ সালের`The colonial Forest Act’ পাল্টায় না, চরিত্র বদল হয় না বনবিভাগের, বনমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রযন্ত্রের। মাঝে মাত্র তিনবছর বাদ দিয়ে ১৯৭৪ সাল থেকেই আবার পুরোদমে শুরু হয়ে যায় বনবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের রকমারি সব কৌশলাদির বহুমাত্রিক প্রয়োগ। মাঝে মধ্যেই নানান অজুহাতে ফলবাগান, ধানীজমি সবকিছুই তছনছ করে দিয়ে যেত বনকর্মকর্তাদের নেতৃত্বে বনরক্ষীরা। বনের অধিবাসীরা স্থানীয় থানায় মামলা করতে গেলেও সেই মামলা গ্রহণ করা হত না।

১৯৭৭ সালে বনবিভাগ কর্তৃক শালবনের ভিতর কৃত্রিম লেক তৈরির নামে কোচ-মান্দিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্পের আওতাধীন এলাকায় হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত অধিবাসীদের উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে। একই বছর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ভেড়া চড়ানোর নাম করে শালবন এলাকার চাপাইদ গ্রামে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে নেয়।

১৯৮১ সালে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বনকর্মকর্তার বিট অফিস প্রতিষ্ঠা ও তুঁত গাছ রোপনের নামে শালবনের মান্দিদের ১০৮ একর জমি দখল করে নেয় বনবিভাগ। আর এই দখল কার্যের জন্য বনবিভাগ প্রায় দুইশত বাঙালি মুসলমানকে জয়নাগাছা, বন্দেরিয়চলা, কেজাই গ্রামে নিয়ে আসে।

১৯৬২ সালের তৎকালীন গভর্ণর আজম খান কর্তৃক ঘোষিত ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্পের সার্থক বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে। সরকারি ভাবেই তখন মধুপুর গড়ের ২০,৮৩৭.২৩ একর বনভূমি নিয়ে মধুপুর জাতীয় উদ্যান ঘোষণা দেওয়া হয়।

১৯৮৪ সালে আবার শালবন দখল হয় নতুন নামে নতুন ভাবে। শালবনের পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবেই টেলকীপাড়া ও নয়াপাড়া গ্রামে বনকে ধ্বংস করে মান্দিদের নিজ জমিতে বিমান বাহিনীর জন্য ফায়ারিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মান্দিরা সাথে সাথেই এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিল তাদের নিয়মতানিত্রক প্রতিরোধ। কিন্তু এই প্রতিরোধে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি বন রক্ষার প্রতিষ্ঠান বনবিভাগ বা রাষ্ট্রযন্ত্র।


৩.শালবন ধ্বংস এবং আদিবাসী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নাম রাবার চাষ উন্নয়ন প্রকল্প, উডলট প্রকল্প....

আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (Asian Development Bank-ADB) অর্থায়নে দ্বিতীয় রাবার চাষ উন্নয়ন প্রকল্প মধুপুর শালবনে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। শালবনের বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থাকে (Ecological Condition) বিবেচনা না করেই সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক স্বার্থে অবৈজ্ঞানিক ও জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) বিধ্বংসী এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই রাবার চাষ প্রকল্পের জন্য ১৫০০০ একর জমি প্রকল্প আওতাধীন ধরা হলেও বনের বাসিন্দাদের বিরোধীতার মুখে ৭০০০একর জমিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। আর এই ৭০০০ একর জমিও দখল করা হয় সেই পুরনো কায়দায় অর্থাৎ মান্দিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। রাবারের মনোকালচারের জন্য ৭০০০ একর জমি থেকে পুরো শালবন কেটে ধ্বংস করা হয়। মাটি থেকে সমূলে উপড়ে ফেলা হয় শালগাছের কপিছ (Sal coppices), যা ঐ এলাকায় ভবিষ্যতে শালবন সৃষ্টির প্রাকৃতিক সম্ভাবনাকেও স্থায়ী ভাবে ধ্বংস করে দেয়। পরে অবশ্য স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে পরিবেশবাদীরা এ ব্যাপারে সোচ্চার হলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্প বন্ধে বাধ্য হলেও শালবনের যে মারাত্বক ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়।

রাবার চাষ প্রকল্পের দুই বছর না যেতেই আসে পাঁচ বছর মেয়াদী (১৯৮৯-১৯৯৫) থানা বনায়ন ও নার্সারী উন্নয়ন প্রকল্প, যা সোস্যাল ফরেষ্ট্রি (Social Forestry) নামে পরিচিত। এবার সেই একই আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (Asian Development Bank-ADB) ৪৬.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প ব্যয়ের ১১.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয় শালবন এলাকায় উডলটের পেছনে। মধুপুরের শালবনে এই উডলট প্রকল্পে শতশত একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেওয়া হয়। উডলটের ব্ল­ক তৈরীর জন্য দখলকৃত জমির কপিছ সহ সমস্ত শালগাছ এবং হাজার হাজার প্রজাতির মূল্যবান ঔষধি গাছ সমূলে বিনষ্ট করা হয়। সেখানে লাগানো হয় Eucalyptus spp., Dalbergia sissoo, Leucaena leucocephala, Swietenia macrophylla এবং Cedra toona ইত্যাদি বিদেশি গাছ। উলে­খ্য যে এসমস্ত গাছ সাধারনত মরু (Barren) এলাকায় বনায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়। অথচ আমাদের এখানে হাজার হাজার বছরের পুরোনো প্রাকৃতিক শালবন ধ্বংস করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রেসক্রিপশনে এইসমস্ত গাছ লাগনো হয়েছে। আর এই সমস্ত আয়োজনই যে শালবনকে ধ্বংস এবং শালবনের আদিবাসী কোচ, মান্দি, বর্মণদের বিপন্ন থেকে বিপন্নতর করে দেওয়ার দেশীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তা বলাই বাহুল্য।


৪.শালবন ধ্বংস এবং আদিবাসী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নাম ইকোপার্ক প্রকল্প...

৯৭.৩ মিলিয়ন টাকার মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের (Modhupur National Park Development Project) আওতায় ফরেষ্ট কনজারভেশন ও ইকোটুরিজম স্কীমের সরকারী অনুমোদন লাভ করে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি, পশু-পাখি ও বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল নির্মাণের ভালো ভালো বুলি আওড়ে মধুপুর গড়ের প্রায় ৩ হাজার একর বনভূমি ঘিরে ৭ফুট উচ্চতার ৬১ হাজার ফুট ইটের দেয়াল এবং ভেতরে ১০টি পিকনিক স্পট, ২টি ওয়াচ টাওয়ার, ২টি কালভার্ট, ৩টি কটেজ, জলাধার সহ লেক ৯টি, রেষ্ট হাউজ ৬টি, রাস্তা নির্মাণ ৬টি, বন কর্মীদের ৬টি ব্যারাক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি জালাবাদা, সাধুপাড়া, বেদুরিয়া, কাঁকড়াগুনি, গায়রা গ্রাম গুলোতে দেয়াল নির্মাণের জন্য বনকর্মীরা জড়িপ কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত সেখানকার আদিবাসীরা এই দেয়াল নির্মাণের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতো না। অথচ এই প্রকল্পাধীন ভূমিতেই রয়েছে হাজার হাজার কোচ, মান্দিদের বসবাস। ইকোপার্কের নামে কোচ, মান্দিদের উচ্ছেদের এটা যে পুরনো উদ্দেশ্যরই নব্য একটি প্রক্রিয়া তা আর বুঝতে বাকি থাকেনা আদিবাসীদের। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে মুক্তাগাছা থানার বিজয়পুর ও সাতারিয়া এলাকায় মান্দি গ্রাম গুলোতে স্থানীয় মান্দিদের তীব্র প্রতিবাদের মুখেও বনবিভাগ প্রথম দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করে। মান্দি, কোচ, বর্মণেরা জানে এই ইকোপার্কের দেয়াল নির্মাণের ভয়াবহতা কত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে তাদের জীবনাচারে। সংঘবদ্ধ হতে থাকে আদিবাসীরা। বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে তাদের দাবিসমূহ বিভিন্ন ভাবে সরকারের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেন। আদিবাসীদের আন্দোলনের চাপে তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ ২০০৩ সালের ৪ জুলাই দোখলায় আদিবাসী নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেন। আদিবাসীরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। অফলপ্রসু এক আলোচনার পর সরকারের পক্ষ থেকে আদিবাসী নেতৃবৃন্দদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যে কমিটি ইকোপার্ক সংক্রান্ত উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রিপোর্ট পেশ করবে। মূলত এই প্রস্তাব ছিল সরকারের পক্ষ থেকে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনকে বানচাল করে দেওয়ার একটা পাঁয়তারা। এই প্রস্তাব পেশ করেই তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে কোন কিছু না বলে চলে যান। পরবর্তীতে বনবিভাগ সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক যারা দীর্ঘদিন ধরে মান্দি, কোচ, বর্মণদের নিয়ে ইকোপার্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন সেই সব প্রকৃত নেতাদের বাদ দিয়ে খ্রিস্ট্রীয় মিশন প্রধান ও কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গের সমন্বেয় পর্যালোচনা কমিটি গঠনের পরিবর্তে মূলত ইকোপার্ক প্রকল্প সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। সরকারের তৈরীকৃত বিশ্বাসঘাতক এই দালাল শ্রেণী এরপর থেকে ইকোপার্কের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য কিছু অকার্যকর মিটিং-সমাবেশের আয়োজন করতে থাকেন। সংগ্রামরত আদিবাসীরা এই চিহ্নিত দালালদের কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে চালিয়ে যেতে থাকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, হা.বিমাকে রক্ষা করার সংগ্রাম। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে গায়রাতে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় ৩ জানুয়ারি ২০০৪ সালে ইকোপার্ক বিরোধী মিছিলের। সেই ঘোষণার প্রেক্ষিতেই ৩ জানুয়ারি -০৪ গায়রা গ্রামে সাধুপাড়া, কাকড়াগুনি, জয়নাগাছা, জালাবাদা, বিজয়পুর, সাতারিয়া সহ আশেপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষ নিজেদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয়। খা সাংমা খা মারাক-ধ্বণিতে মুখর হয়ে উঠে পুরো শালবন এলাকা। এদিকে সমাবেশ ও মিছিলের খবর পেয়ে সকাল থেকেই সেখানে সরকারের পক্ষথেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও অস্ত্রধারী বনরক্ষীদের এমনকি ঠিকাদারের ভাড়াটে লোকদেরও মোতায়ন করে রাখা হয়েছিল। সমাবেশ শেষে দুপুর বারোটার দিকে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলটি কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরপরই পুলিশ ও বনরক্ষীদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু হলে ঘটনা স্থলেই নিহত হন জয়নাগাছা গ্রামের বিশ বছরের যুবক পীরেন স্নাল; গুলিবর্ষণে মারাত্মক আহত হন রবীন সাংমা, উৎপল নকরেক, এপ্রিল সিমসাং, পঞ্চরাজ ঘাগ্রা, রহিলা সিমসাং, শ্যামল সাংমা, রিতা নকরেক সহ প্রায় ২৫জন আদিবাসী শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষ। এই ঘটনার পরপরই আদিবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। মাসব্যাপী চলে তাদের তুমুল বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ। এদিকে বনবিভাগ বা সরকার শুধু হত্যা ও আহত করেই থেমে থাকেনি। ৪ জানুয়ারি রাতেই নিহত পীরেন স্নাল ও গুলিতে আহত উৎপল নকরেক, জর্জ নকরেক, শ্যামল সাংমা, মৃদুল সাংমা, হ্যারিসন সাংমা, বিনিয়ান নকরেক সহ অজ্ঞাত প্রায় ছয়শত জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে মধুপুর থানার হাবিলদার বাদী হয়ে। এভাবেই বনবিভাগ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করে। শুধুমাত্র জুন ২০০৩ - জুলাই ২০০৪ পর্যন্তই আদিবাসী নেতৃবৃন্দসহ নিরীহ অনেকের নামে বনবিভাগ বা সরকার মামলা দায়ের করে মোট একুশটি। এই একুশটি মামলার সবকটিতেই যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন অজয় মৃ, প্রশান্ত মানখিন, পঞ্জরাজ ঘাগ্রা, মালতি নকরেক, স্বপন নকরেক, নেরি দালবত, মাইকেল নকরেক, চলেশ রিছিল প্রমুখ। আর পীরেন হত্যার পর আদিবাসীদের পক্ষ থেকে যে মামলা দয়ের করা হয়েছিল তা উপযুক্ত তথ্য-প্রমান নেই এই অজুহাত দেখিয়ে খারিজ করে দেয় ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত; অথচ গুলিতে গুরুতর আহত অনেকেই হুইল চেয়ারে করে আদালতে গিয়ে সাক্ষী দিয়ে এসেছিলেন। শুধু তাই নয়,পীরেন স্নাল নিহত হওয়ার পরপরই বনবিভাগ ঘটনার দায়ভার এড়াতে রাতের অন্ধকারে শালবনের বিপুল সংখ্যক গাছ কেটে সরিয়ে নেয়, আর পরবর্তীতে গাছ চুরির মামলা ঠুকে দেয় নিরীহ আদিবাসীদের নামে। এই হচ্ছে বনবিভাগ বা রাষ্ট্র কর্তৃক জীববৈচিত্র্য রক্ষার নমুনা।


৫.খা সাংমা, খা মারাক...

বনবিভিাগ ও রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে এযাবতকালে যতগুলো পরিকল্পনা-প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার কোনটাই যে শালবনকে, শালবনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার জন্য নেওয়া হয়নি বরং সেখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদের মাধ্যমে শালবনের সম্পদ লুট-পাট করার তা অতি স্পষ্ট। যে বনবিভাগ বনরক্ষার (?) মহান ব্রতে (!) নিয়োজিত সেই বনবিভাগের কর্মকর্তারা নিজেরাই কালোবাজারিদের সাথে আতাঁত করে শালবনের সম্পদ পাচার করে আর আদিবাসীদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে চলে। টেলকী গ্রামের এক সিরিন নকরেকের বিরুদ্ধেই বনবিভাগ মামলা দায়ের করেছে প্রায় অর্ধশতকের মতন। বনের গাছ চুরির অভিযোগে সিরিন নকরেক জেলে থাকাকালীন সময়েও তার বিরুদ্ধে গাছ চুরির নতুন নতুন মামলা হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, জেলে থাকাকলীন সময়েও একজন লোক কিভাবে বনের গাছ চুরি করতে পারেন ? এর সদুত্তর বনের বাসিন্দারা কখনো পায়নি বনবিভাগের কাছে বা রাষ্ট্রের কোন প্রশাসন যন্ত্রের কাছে। তারপরেও বনের বাসিন্দারা বারবার বনকর্মকর্তাদের গাছ পাচার বন্ধ করতে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন শালবনের সম্পদ রক্ষা করতে। আর এর জন্য ১০ এপ্রিল ১৯৯৬ সালে জয়নাগাছা গ্রামের বিহেন নকরেককে দিনেদুপুরে জীবন দিতে হয়েছিল বনরক্ষীর গুলিতে। বিহেনের অপরাধ ছিলো ঘটনার দিন বনের ভেতর পাতা কুড়াতে গেলে সে বনবিভাগের গাছ চুরি দেখে ফেলে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এরপর উল্টো বনবিভাগের দাযেরকৃত গাছ চুরির মিথ্যা মামলায় আদালত রায় দেয়, বিহেনকে গুলি করা বৈধ হয়েছে কারন সে বনের গাছ চুরি করছিলো। অথচ বন আইনে গাছ চুরি করলেও কাউকে পিছন থেকে গুলি করার নিয়ম নেই। এই হচ্ছে শালবন ও বনের আদিবাসীদের উপর বনবিভাগ বা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রহসনের বাস্তব প্রতিচিত্র। কিন্তু শালবনের যারা আদিবাসিন্দা, শালবন যাদের জীবন-ধর্ম-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সেই মান্দি, কোচ, বর্মণেরা কোনভাবেই এই শালবনকে ধ্বংস হতে দিতে পারে না, নিজেদের অস্তিত্ব, জীবন, সংস্কৃতিকে কোন ভাবেই বিলীন হতে দিতে পারে না। আর সেজন্যেই যুগে যুগে তারা লড়াই করে এসেছে সমস্ত ষড়যন্ত্র, কালো আইন, নির্যাতন-নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা, উচ্ছেদ আর দেয়াল নির্মাণের বিরুদ্ধে। পীরেন স্নাল সেই সংগ্রামী চেতনাকে ধারন করেই নিজ হা.বিমা ও নিজ জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন নিজ হা.বিমার বুকে। হা.বিমার বুক থেকে পীরেন স্নালের রক্তের যে আহবান ধ্বনিত-প্রতিধ্বণিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত সেই আহবানকে কখনো উপেক্ষা করতে পারে না হা.বিমার সন্তানেরা। বিহেন নকরেক, গীদিতা রেমা ও বীর পীরেনের সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করেই হা.বিমার সন্তানেরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, শালবন তথা হা.বিমাকে রক্ষার জন্য লড়ে যাবে নিরন্তর।

তথ্যসূত্র ঃ
১.Bangladesh Land, Forest and Forest People Editor-Philip Gain Published by- SHED, Dhaka.
২.সংহতি ২০০৪।।সম্পাদক-সঞ্জীব দ্রং।। প্রকাশনায়-বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; বনানী, ঢাকা।
৩. বিপন্ন ভূমিজ, অস্তিত্বের সংকটে আদিবাসী সমাজ, বাংলাদেশ ও পূবৃভারতের প্রতিচিত্র।। সম্পাদনা- মেসবাহ কামাল,আরিফাতুল কিবরিয়া।। আরডিসি, ২০০৩ ,ঢাকা।।
৪.মান্দিরাংনি চিঠি ।। সম্পাদক-প্রশান্ত চিরান।। ত্রয়োদশ বর্ষ-৫ম সংখ্যা,অক্টোবর ২০০৩।। প্রকাশনায়- ফারাকা কালচারাল এসোসিয়েশন।
৫.আচিক।। সম্পাদক-অর্পন যেত্রা।। বর্ষ-২, সংখ্যা-২, ফেব্রুয়ারি-মার্চ-২০০৪।। ঢাকা।
৬. খোলা চোখ।। সম্পাদক- খোকন রিছিল।। প্রকাশনায়- প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ।। ৪৩৪ জগন্নাথ হল , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।। আগস্ট ২০০৩, ঢাকা।
৭.দৈনিক প্রথম আলো (৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১৩, ২৩, ২৭ জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যা), ঢাকা।
৮. দৈনিক ভোরের কাগজ (২৭ জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যা), ঢাকা।
৯.দৈনিক জনকন্ঠ (২৫, ২৭ জানুয়ারি২০০৪ সংখ্যা), ঢাকা।
১০.সাক্ষাতকার-আলবার্ট মানখিন, ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের নেতা।



Thursday, August 30, 2007

মৃত্তিকা : বর্ষ ক্রম: ০১;সংখ্যা ক্রম: ০১


মৃত্তিকা
জাতিতাত্ত্বিক লোকায়ত জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ
প্রথম বর্ষ : প্রথম সংখ্যা ।। ২৫শ্রাবণ ১৪১১ বঙ্গাব্দ, ৯ আগস্ট ২০০৪ খৃ:।। বিনিময় : ৬ টাকা
সম্পাদনা: জুয়েল বিন জহির, পরাগ রিছিল, দুপুর মিত্র
৩৪৭ শহীদ সালাম বরকত হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত।


আদিবাসী দশক শেষ হইল
বাঙালির সংবিধান বাঙালিরই রইল



পাভেল পার্থ
…......................................................


বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন
(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ৬নং অনুচ্ছেদ, ১৯৭২)
………………………………………………...........

আমরা কখনো বলিনি, এই জনপদের মালিক আমরা।
এই মাটির মালিক আমরা। এই জলধারা সমূহের মালিক আমরা। এই পাহাড় জঙ্গলের মালিক আমরা। বীজ শস্য, উঁইঢিবি, মানুষ, পাখি, মাছ বা জানোয়ারের মালিক আমরা। আমরা কখনো তো মালিকানা দাবি করিনি।

কিইবা এমন বিনিয়োগ আছে আমাদের ?
কেনইবা আমরা খরিদ করে ফেলবো আস্ত দুনিয়া ?

আমরা কেবল জানি ও মানি এ দুনিয়ার মালিক আমরা মানুষেরা নই। আমরা কখনোই জল, পাথর, জঙ্গল, প্রাণবৈচিত্র্য বিক্রি করার কোনো চিন্তাই করিনি। কিন্তু মানুষেরাই যারা কখনোই আমাদের লগে আমাদের গ্রাম, পাড়া, আদাম, পুঞ্জি, কামি, সঙ, টিলা, জঙ্গলে বেড়ে ওঠেনি তারাই ছড়ার জল থেকে, নদীর বুক থেকে খুঁড়ে তুললো বালির ঢিবি। পিআইন নদীর শরীর কেটে কেটে তুললো পাথরের চাঁই। তারা মাধবকুন্ডের আমডেবিটের জল বোতলে বোতলে ভরে বিক্রি করল। তারা জঙ্গলের পর জঙ্গল কেটে চা বাগান আর রাবার বাগান করল। বলসাল ব্রিং হত্যা করে একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম গাছ লাগাল। আমরা কেবল এইসব খুন-জখমের প্রতিবাদ করেছিলাম।

আমরা জানি জঙ্গল আমাদের মা।

১৮৭২-৭৩ এ যখন মানুষেরা এসে টেনে টেনে খাবলে খাবলে আমাদের মায়ের শরীর থেকে সব পশম আর চামড়া তুলে সেগুন গাছ লাগাল, আমরা কেবল আমাদের মাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমরা তো মায়ের শরীরে একটা কোপও দেইনি মায়ের অনুমতি ছাড়া। হারাছুড়ি, বান্দরবান, রাঙামাত্ত্যাতে যখন আমরা ত্রিপুরারা হউক করতাম, আগে আমরা বুরাসার ধারে অনুমতি চাইতাম; আমরা চাঙমারা জুম করার আগে মাইলুংমার ধারে অনুমতি চাইতাম; আর আমরা যারা ম্রাইনমা, আমরা ইয়ার জন্য অনুমতি চাইতাম বুমিনের ধারে; মান্দিরা হাবাহুছাআর জন্য মিসি সালজং এর ধারে।

কিন্তু আমাদেরকে বলা হয় জুম চাষ পরিবেশ নষ্ট করে। বলা হল এইসব আদিম প্রথা ছেড়ে আমাদেরকে আধুনিক হতে হবে। আধুনিকতা মানে কি তা কখনোই আমাদের জানা ছিল না। জুম নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের নীতি বা জুম নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের বিরুদ্ধে তো আমরা যাইনি কখনো, আমরা তো কখনোই প্রশ্ন তুলিনি জুমও তো একদল মানুষের আপন চাষবাস একে কেন বন্ধ করা হবে? রাতারাতি আমাদের পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড় গুলো সাফ করে জলপাই রঙের পোশাক পড়ে বন্দুক নিয়ে মানুষেরা এল। এককালে দল বেঁধে আসা ভিনদেশী ধলা চামড়াদের কথাবার্তা আমরা বুঝতামনা, ধলা চামড়ারা যেভাবে বলত আমরা কেবল তাদের ক্যামেরার দিকে ভয়ে তাকিয়ে থাকতাম, আর এখন বন্দুকের দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয়। উন্নয়নের কথা বলে আমাদের হর্নফুলি গাঙে কাপ্তাই বাঁধ দেয়া হল। ভেসে গেল আমাদের জুম, বসত আর জীবন। আমরা ডুবে যাওয়া মাওরুম আদাম থেকে পাহাড় পেড়িয়ে পাহাড় কোথাও জায়গা পেলামনা।
হয়তোবা বনবিভাগ জঙ্গলকে বাঁচাতে চায়, আর তাই আমাদের নামে বন মামলা দেয়। আমরা তো আবার সংরক্ষণ,পরিবেশ, উন্নয়ন এইসব বিষয় বুঝি না। আমরা কেবল জানি যে জঙ্গল-মাটি-জল আমাদের মা। আমরা মাকে খুন করি না, আমরা মাকে বিক্রি করি না, আমরা মাকে দখলও করি না, রক্ষাও করি না। আমরা মাকে বিপন্ন না করে তার লগে বড় হতে শিখি।

আমরা হাজং, মান্দিরা সুসং দূর্গাপুরে রাজার চোখ রাঙানিতে হাতি ধরে দিইনি বলে রাজা অবাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা জানি জানোয়ার-পতঙ্গ-পাখি-মাছ গুলো আমাদেরই ভাই-বোন, আমরা সবাই একই দুনিয়ার মায়ের পেটে জন্ম নিয়েছি। নিজের ভাইকে, নিজের বোনকে কী কেউ রাজার হাতে তুলে দেয়??? রাজাতো সেই হাতিকে কেটে কেটে টুকরা করে সিমসাং এর জলে ভাসিয়ে দিত কেবলমাত্র দাঁতগুলোর জন্য। আমরা বোন ভাইয়ের হত্যার প্রতিবাদে তাই রাজা অবাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। এখনও আমাদের শেরপুর আর জামালপুরের কোচ-মান্দি গ্রামে হাতিরা এসে ফসলের জমি, বসতভিটা তছনছ করে যায়, আমরা এখনো রাজা অবাধ্যই আছি!

আমরা ভেবেছিলাম বনবিভাগ জঙ্গলকে বুঝবে।
বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, প্রাণবৈচিত্র্যের হা- হা-কা-র শুনবে।
যখন বনবিভাগের মানুষেরা মেনকীফান্দার পাহাড়ে বলসাল ব্রিং সব মুথা সহ তুলে ইটের ভাঁটায় দিল আমরা মেনকীফান্দার পাহাড়ে মায়ের লগে আগলে থাকার জন্য জীবনবাজি রেখে দাঁড়িয়েছিলাম।

....................................................................................................................

সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অথার্ৱ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার-এই নীতিসমূহ এবং তৱসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।


(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং-৪, সংযোজিত ১ক দফা, ১৯৭৮)
...........................................................................................................................

আমরা কখনোই আমাদের বুরাসা, মিসি সালজং, সুসিমি, চিগা, তাতারা রাবুগা, বুমিনে, গয়েরা, অসামোতাই, ইয়ালারাম, দুকুমগুনি, খাঙখাঙি, চরবুড়ি, বাস্তু, লিনাসা, মিনাসা, উব্লাই নাংথউ, ধরম করম, বাগবাদের কথা তুলিনি। আমরা জানি আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানদের লগে আমাদের দুর্বল বিশ্বাস গুলো কখনোই দাঁড়াতে পারে না।

আমাদেরতো কোনো পুস্তক নাই!
আমাদের আবার কিসের ডাঁট, কিসের চাউনি!!

সাংসারেক, জন্টিল, ছোনং বা ক্রামা তো কেবলি আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমরা মানি আরো না জানি কত কত বিশ্বাস এই দুনিয়ায় আছে। তারবাদেও আমরা আমাদের বিশ্বাসগুলোকে চালু রাখার জন্য, নিদেনপক্ষে লুকিয়ে রাখার জন্যও একটুকরা জংলা, পাথর বা জায়গা পেলাম না এই দুনিয়ায়। যখন দেখি ঈদ, দূর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা বা বড়দিনের জন্য সব ছুটি থাকে আমরা কিছুই ভাবি না। আমরা কখনোই ওয়ান্না, বৈসুক, বিজু, সাংগ্রাই, গরাইয়া, পুষরা, করম, কামাখ্যা, বাহা, গালমাকদুআর জন্য কোনো ছুটি দাবি করিনি।
আমরা নিশ্চয়ই এমন আহামরি কিছু হয়ে যাইনি যে চাইলাম আর পাইলাম।
আর কিইবা এমন উৎসব আমাদের।
আমরা বড়জোড় না হয় একটু নাচগান করবো আর মদ খাবো।
.................................................................................................................................
প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মো প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।


( গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অষ্টম সংশোধনী, ২নং অনুচ্ছেদে ২ক নামে সংযোজিত দফা, ১৯৮৮ )
...................................................................................................................................

আমরা কখনোই কোনো শান্তির কথা বলিনি।
আমরা জানি না যখন ব্যাঙের ঠ্যাং বস্তায় ভরে ভরে মানুষেরা বিক্রি করে, যখন বলসাল ব্রিং থেকে জংলা আলু পাচার হয়ে যায়, যখন একাশিয়া আর রাবার বাগানে একবিন্দু জলও খুঁজে পায়না কেঁচো বা গুইসাপ তখন মানুষ কি করে শান্তিতে থাকে।
আমরা যখন চা বাগানে কাজ করি, সাহেব বাবুদের ঘুম যদি ভেঙে যায় আমরা মাদলেও জোড়ে বোল দিই না।

চা বাগানে কেন গিরমিট আইন চালু থাকে এসব নিয়েও আমাদের কোনো প্রশ্ন নাই।

আমরা কেবল ভাবতেও পারিনি আমাদের মায়ের শরীর টুকরা টুকরা করে বস্তায় ভরে বিক্রি করবে মানুষেরাই; পাহাড়ের নাম, মায়ের নাম যাদের কাছে কেবলমাত্র চীনামাটি-সাদামাটি।
...............................................................................................................................

সকলক্ষেত্রে উপজাতি শব্দটি বলবত থাকবে
(১নং শর্ত,পার্বত্য চুক্তি ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭)
................................................................................................................................

আমরা এইসব শব্দ-ফিরিস্তি আর বাতচিৎ গুলার মর্মও বুঝি না। উপজাতি,পাহাড়ি,আদিবাসী,সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা,নৃ-গোষ্ঠী,ভূমিজ, ক্ষুদ্রজাতি,ট্রাইবাল,ইন্ডিজিনাস পিপল-এইসব পরিচয়ে আমাদের এমন কিইবা যায় আসে?
বলা হয়ে থাকে যে, সারা দুনিয়ায় ৭০টিরও বেশী দেশে পাঁচহাজার জাতির ৩০কোটি এমন মানুষেরা বাস করেন, যারা আমাদের মতনই দুনিয়াকে কেনাবেচা করতে চান না আর নিজেদেরকে মালিক হিসেবে জাহির করেন না। জানা যায় আমরা অনেক আদিম, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সেকেলে, বন্য, অসভ্য,উপজাতি,জংলী,আদিবাসী বলে সারা দুনিয়ার ডাকসাইটে দরদী মানুষেরা আমাদের উন্নত আর আধুনিক করতে চায়। মহামান্য জাতিসংঘও আমাদের তরে আকুল। জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী বর্ষ, প্রতিবছর ৯ আগস্ট কে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস আর ১৯৯৫-২০০৪ সালকে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দশক ঘোষণা করে। আদিবাসী দশকের মূল চিন্তা নাকি ছিল : Indigenous people: Partnership in action .
এ দশকের কর্মসূচীর ভেতর ছিল:
· ১৯৯০ দশকের প্রথমদিকে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে গৃহীত আদিবাসী সংক্রান্ত সুপারিশমালার বাস্তবায়ন;
· জাতিসংঘ সিস্টেমের ভিতরে আদিবাসীদের জন্য একটি স্থায়ী ফোরাম গঠন করা;
· আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের সমাপ্তকরন ও গৃহীত করন;
· জাতিসংঘ সিস্টেম, মানবাধিকার ও আদিবাসী অধিকার ইত্যাদি সর্ম্পকেজানার জন্যে জাতিসংঘ আদিবাসী ফেলোশিপ প্রোগ্রাম চালুকরন;
· আদিবাসী মানুষের অবস্থা, সংস্কৃতি, ভাষা, অধিকার, এবং আশা আকাংখা ইত্যাদি সর্ম্পকে আদিবাসী ও অ- আদিবাসীদের শিক্ষা দেয়া;
· আদিবাসী জনগোষ্ঠী লাভবান হয় এমন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হাতে নেয়ার জন্যে জাতিসংঘ সিস্টেম কর্তৃক বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করা;
· আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ করা এবং তাদের ক্ষমতায়ন করা যাতে করে তারা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে
পূর্ণ মর্যাদার সাথে নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ভাষা, ঐতিহ্য এবং সামাজিক সংগঠন সহ সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখতে পারে;
· বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৯ই আগষ্টে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা;
· পর্যাপ্ত স্টাফ ও রির্সোস সম্বলিত আদিবাসীদের উপর জাতিসংঘ ইউনিট স্থাপন করা এবং এ দশকের কার্যবলী সম্পাদনে সহযোগিতা
প্রদানের জন্যে দক্ষতাসম্পন্ন আদিবাসী ব্যক্তিদের নিয়োগ করা।

যদিও আমরা কোনো অংশীদারিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি, কিন্তু আমরা জানি অ্যাকশন মানে কি।

অ্যাকশন মানে উন্নয়ন।

উন্নয়ন মানে আমাদের বসত-জুম সহ নিরন্তর উচ্ছেদ, জঙ্গল বিনাশ, বাঁধ দিয়ে গ্রাম-জংলা ডুবিয়ে দেয়া, পর্যটন আর গবেষণার নামে আমাদের জীবন আর প্রাণবৈচিত্র্যের চুরি বিক্রি আর দখল, তেল আর গ্যাস কোম্পানির হরহামেশা লুটপাট-দখল আর জখম, বনায়নের নামে জীবন ও প্রকৃতি লুট।
আমরা তো এই দুনিয়ার কাছে কখনো কোনো অংশীদারিত্ব, কোনো অ্যাকশন দাবি করিনি । আমরা তো কোনো উন্নয়নের দাবি তুলিনি। জানি, তারবাদেও এই বাংলাদেশে সারা দুনিয়ার মতনই আমরা নিপীড়িত হবো, বিপন্ন হবে আমাদের মা, মানে আমাদের সকলের প্রাণবৈচিত্র্য। কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এই রাষ্ট্রে কখনোই ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস পালিত হবে না। আমরা তো সেরকম দাবি তুলে রাষ্ট্রকে ঘাবড়েও দিতে চাই না। আমরা জানি আমরা কখনোই এই রাষ্ট্রে আমাদের আপন হিসাবে আমাদের কোনো হিসাবপত্তর, ইতিহাস জানতে পারবোনা কখনোই।

...................................................................................................................
বাংলাদেশে উপজাতীয় জনসংখ্যা ১২০৫৯৭৮ জন
(আদমশুমারি রিপোর্ট, ১৯৯১, বাংলাদেশ)
......................................................................................................................

আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য, আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য রাষ্ট্রের এতো দরদে আমাদের লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়। আমরা এমন কি মানুষ যে আমাদের জন্য এতোসব!
রাঙামাত্ত্যা, হারাছুড়ি, রাজশাহী, বিরিশিরি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমী ইনস্ট্যুট গুলো দেখে আমরা লজ্জায় কোথায় যে লুকাই।
ধরনীও আর আমাদের ডাকে মাটিতে চির ধরায় না।
এইসব এতো আয়োজন, এতো অর্থ খরচ আমাদের জন্য করার এমন কি দরকার!
এইসব কাজকারবার নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলি না, আমরা কখনোই বলিনি ওইসব দালানকোঠা আমাদের অপরিচিত; আমরা জানি টংগা, মোনঘর, বুরাং, নকমান্দি এসব ঘরদোর এই ভদ্দর সমাজে চলে না।
আর ওইসব দালানকোঠার বই-পুস্তকে কি সব লিখা হয় আমরা জানার সাহসও করি না।

আমরা তো এই রাষ্ট্রের কাছে কখনোই প্রশ্ন তুলিনি, কেন আমাদের উপজাতি বলা হয়?

আমরা তো কখনোই প্রশ্ন তুলিনি কেন আমাদের মান্দি না বলে গারো, শো না বলে খিয়াং, লাইমি না বলে বম/বনযোগী, ম্রো না বলে মুরং, ম্রাইনমা না বলে মারমা, জৈন্তিয়া না বলে হিন্দু খাসিয়া, ত্রিপুরী না বলে টিপরা, লালং না বলে পাত্র বলা হয়?
মানুষের এইসব পরিচয়ে কিইবা এমন যায় আসে। আমরা জানি আমাদের এই দুনিয়ার সব মানুষের রক্তই লাল।
আমরা কখনোই চেঙ্গী, হর্ণফুলি, কংস, মাতামুহ্‌রী, সিমসাং নদী থেকে বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, যমুনা, করতোয়া, চিত্রা, সুরমা, মনুকে আলাদা করে দেখিনি।
পেগামারি, লোগাং, লংগদু, নানিয়ারচর গণহত্যায় আমাদের অস্তিত্ব যেমন ডুকরে ওঠে একইভাবেই আমরা ডুকরে ওঠি কালিগঞ্জে চিংড়ি ঘেরে, ঘুঘুদহ বিলে, নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টসে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হেফাজতে যখন মানুষ খুন হয়।
গজনীতে অবকাশ কেন্দ্রের নামে আমাদের কোচ, হাজং, মান্দি বসত উচ্ছেদ নয়, জঙ্গলের দিগ্গিলেগ্গ্যে ছড়াটির জন্য আমাদের মায়া হয়; আমাদের একই মায়া যখন হাকালুকি হাওড়ে বিষ দিয়ে পাখি মেরে ফেলা হয়, বাঁধ দিয়ে বিল ডাকাতিয়াকে যখন খুন করা হয়।
জুমবসত থেকে আমাদের উচ্ছেদ হতে হবে বলে নয়, আমাদের মা আমাদের জঙ্গল আর মাধবকুন্ড-মুরইছড়াকে বনবিভাগ ইকোপার্কের নামে খাবলে খাবলে বদলে দিতে চাইছিল বলেই আমরা মাকে বাঁচাতে জঙ্গলকে বেড় দিয়েছিলাম। বনবিভাগ আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে থাকে।
বনবিভাগও নাকি জঙ্গল বাঁচাতে চায়!
আমাদের সকল খাসিয়া জনপদ দখল আর উচ্ছেদ হয়ে গেলেও আমরা কিছু বলিনা। আমরা জানি আমরা রাশিমনি হাজং, আমরা বসন্ত বুনারজী, কম্পরাম সিং, বিহেন নকরেক, নিন্তনাথ হাদিমা, লেবিনা হাউই, স্মৃতি রিছিল, আলফ্রেড সরেন, কল্পনা চাকমা, সেন্টু নকরেক, গীতিদা রেমা, অধীর দফো, অবিনাশ মুড়া, লীলাবতী সিংহ, পীরেন স্নাল।
আমরা জানি, আমরা যতদিন টিকে আছি আমাদেরকে নিরন্তর খুন, জখম আর উচ্ছেদ হতে হবে বারবার এই দুনিয়ার জুম-জমিন-ভূমি-জঙ্গল আর প্রাণবৈচিত্র্যের আপন অধিকারের লাগি।

..........................................................................................................................

প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা
(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, প্রথমভাগ, ৩নং অনুচ্ছেদ, ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংশোধিত)
..........................................................................................................................

আমরা কখনোই আ.চিক, চাঙমা, সাঁওতালী, ককবরক, খাসিয়া, লালং, কোচ, খাড়িয়া, বিষ্ণুপুরিয়া ঠার, হাজং, লাইমি ভাষার কথা বলি না।
আমরা কি কখনো দাবি তুলেছি আমরা সবাই আমাদের আপন ভাষায় বাড়তে ও বাঁচতে চাই। কিংবা আমরা যদি বলি আমরা আমাদের মায়ের ভাষায় পড়তে চাই, এটা কি আমাদের রাষ্ট্রের পক্ষে কখনোই চালু রাখা সম্ভব ?
আমরা এমন বেকায়দায় কাউকে ফেলতে চাই না কখনোই।

আমাদের এমন কি ভাষা আর অক্ষর-হরফ আছে যে আমরা দুনিয়াকে উল্টেপাল্টে দেখতে পারি!!!

আমরা কখনোই দিগ্গিবান্দির প্রসঙ্গ তুলতে চাই না, রেরে, গেংখুলী, আজিয়া, শেরানজিং পালা, দূর্গাপালা, রাধামন ধনপুদি, রাসলীলানুসরন, ঝুমুর এইসব কি আর এমন আহামরি আয়োজন যে আমরা জাহির আর হাজির করবো।



................................................................................................................................

যে কোন বহুজাতিক কোম্পানি যে কোনো শস্য, ফসল, উদ্ভিদ, প্রাণীকে এবং মানুষের জ্ঞান ও অনুশীলন পেটেন্ট, দখল, চুরি করতে পারবে এবং একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবে
২৭.৩(খ) ধারা, বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাসত্ব চুক্তি(ট্রিপস)
................................................................................................................................

আমরা তো আর এতো খোঁজখবর রাখি না যে কে কার জ্ঞান, কে কার সম্পদ চুরি করল। আমরা তো কখনোই ভাবিনি জ্ঞানের কোনো একক মালিকানা হয়। আমরা তো জানি আমাদের আপন জ্ঞান আমাদের সমাজে আপন কায়দায় সামাজিক ভাবে গড়ে ওঠে। আমাদের সমাজে ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ, মেইবা, গুনীন, মেইপা, খোদনী, অচাই, অসাই, কামাল, সেমাকামাল, দেবর্ষি এরা এমন কিইবা চিকিৎসা জ্ঞান রাখেন আর গাছগাছরা চেনেন যে তাদের জ্ঞান চুরি করা ঠেকাতে আমরা হুলুস্থুল কান্ড ঘটাবো।

আর, মানুষ কেন মানুষের জ্ঞানই চুরি করবে ?
মানুষ কেন মানুষের জ্ঞানই বিক্রি করবে আমরা বুঝি না।

আমাদের নারীরা যখন পিনন, খাদি, পাচাতি, ইনাফি, দকমান্দা, গান্দা, পাথিন বানাবার রঙ ও তুলা আর আশেপাশে খুঁজে পান না তখনও আমরা এই হাহাকার আর বিপন্নতা কাউকে বুঝতে দিই না।
খবরক, গ্যাল্লং, দেমব্রা জাগেদং, মিমিদ্দিম, মিমামিশি, চাপলি মাই, বিনি সহ অগণিত জুম ধান ও শস্য ফসলের বৈচিত্র্য হারানোর জ্বালা আমরা ঢেকে রাখি নিরন্তর।
জুম-জংগলে আমাদের আলু তোলা, জংলিশাক, অষুধের গাছ সংগ্রহ বা শিকার করার অধিকার হারানোর কথা আমরা এই দুনিয়ায় কাউকে বলিনি কখনো।
................................................................................................................................

রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।
(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ২৩, ২০০০সালের ৩১ ডিসেম্বর সংশোধিত)
.................................................................................................................................
আমরা কখনোই ভাবিনি হারমোনিয়াম, তবলা, গীটার আর কীবোর্ডের দুনিয়ায় গঙগেন্দা, দামা, খ্রাম, নাথুকও কোনো বাদ্যযন্ত্র।
আমরা তো, কেন সবখানেতে নাপ্পি, ওয়াকখারি, লেবাহাক, দোচুয়ানি, চু, লাঙ্গি, বিখাশাম, সুঞ্জি, চিডৌ, মেওয়া পাওয়া যায়না এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি কখনো।
আমরা জানি তারবাদেও এই রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রের প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙালীরা আমাদের জন্য কতই না চিন্তিত, কতই না উদগ্রীব।

ইকোপার্কের নামে এই রাষ্ট্র আমাদের ধরে রাখতে চায়।
বিদিশি আগ্রাসী গাছ দিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
চিড়িয়াখানা বানিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
বনায়নের নামে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
বাঁধ দিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
ক্যামেরা দিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
ব্যাটাগিরি দিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
যাদুঘর বানিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
উন্নয়নের নামে আমাদের ধরে রাখতে চায়।
দলিল দস্তাবেজের মাতম তুলে আমাদের ধরে রাখতে চায়।

আর এই রাষ্ট্র নিরন্তর তার পবিত্র সংবিধান দিয়ে আমাদের ধরে রাখতে চায়।

হে মহান রাষ্ট্র, আমরা কখনোই রাষ্ট্রের সংবিধানের পবিত্রতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি, তুলবোও না কোনোদিন। আমরা কেবল এই জানি যে, সকল প্রাণসত্তা আর মানুষের জন্য সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের সংবিধানকেই পবিত্র বলে। ধরে রাখার অপর নাম যেখানে বন্দী করা বা নিপীড়ন নয়।


...............................................................................................................



বাংলাদেশের ভাষাঃ ‘বাংলা’ ভিন্ন অন্যান্য ভাষার কথা


জুয়েল বিন জহির



ভাষা মানব সভ্যতার বিবর্তনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মানুষের বাগযন্ত্র কর্তৃক উৎসারিত ধ্বণি অর্থময়তা লাভের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছে ভাষার। ধ্বণির অর্থময়তা স্থান, কাল, জাতিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। আর ধ্বণির এই বহুমাত্রিক অর্থময়তাই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভেতরে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ভাষার। ভাষাভিত্তিক ঐক্যকে কাজে লাগিয়েই নিজস্ব যুগবাহিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, লোকায়ত জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে কোন জনগোষ্ঠি গড়ে তোলে নিজস্ব স্বাজাত্যবোধ, স্বাতন্ত্রতাবোধের। নিজ ভাষার মাধ্যমেই কোন জাতিসত্তার মধ্যকার সংস্কৃতিগত বিভিন্ন উপাদানগুলি তার আপন লয়ে প্রকাশিত, বিকশিত, ও সঞ্চালিত হয় যুগযুগান্ত ধরে নানান পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের রাজনৈতিক সীমানার পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত এই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আজ বিশ্বব্যাপী। বাঙালি জাতির গৌরবের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ পৃথিবীব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাতৃভাষা হল বাংলা; বাকি প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা। এই ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রায় ৪৫টি পৃথক পৃথক জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত। তাদের শারীরিক ও মানসিক গড়ন, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বৃহত্তর বাঙালি জাতির জীবন-সংস্কৃতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। এই ৪৫টি জাতিসত্ত্বাই আবার নিজেদের মধ্যে ভাষা, সমাজ-সংস্কৃতিতে একে অন্যের থেকে পৃথক এবং স্বাতন্ত্রতার অধিকারী। এই জাতিসত্তা গুলির নিজ নিজ ভাষা রয়েছে, রয়েছে তাদের বর্ণাঢ্য লোক সাহিত্য, লোক সংস্কৃতি; যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে অধিকতর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ভাষার সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় ক্ষুদ্রায়তনের এই বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপটিকে ভাষার জীবন্ত জাদুঘর বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির ভাষা সমূহকে নিমো্নক্ত ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে-

১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিক ভাষা সমূহ
১.১. মোন-খমের শাখা- খাসিয়া
১.২. মুন্ডারী শাখা- সাঁওতাল, মুন্ডা, সিং, বিন্‌ধ,হো ইত্যাদি।
২. ভাষা পরিবার- টিবেটো-চীন
২.১. বোডো শাখা- আচিক,ককবরক,হাজং,লালেং, পালিয়া ইত্যাদি।
২.২. কুকি-চীন শাখা- মৈতৈ মণিপুরী, খুমি, লাইমি, কুকি, ম্রো, পাংখো, ইত্যাদি।
২.৩. সাক্‌-লুই শাখা- চাক, থেক বা ঠেট বা থেক , লুসাই।
২.৪. বার্মীজ শাখা- রাখাইন বা ম্রাইনমা
৩. ভাষা পরিবার- দ্রাবিড় কুরুখ, পাহাড়িয়া, মাহালি ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার -ইন্দো-এরিয়ান বাংলা, চাকমা, তন্‌চংগা, রাজবংশী, কোচ, মাহাতো, বসাক,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী,
বিহারী, ভূইমালি ইত্যাদি।

এবার বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি ভাষার সাধারণ পরিচয় তুলে ধরা যাক-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিকঃ ভাষা তাত্ত্বিকদের দীর্ঘপরিশ্রম লব্ধ গবেষণায় যতদুর জানা গেছে বাংলার সর্বপ্রাচীন ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা পরিবারের ভাষা। ভারতবর্ষে প্রচলিত এই ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ভাষা সমূহ অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখা--র ভাষা বলে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রচলিত অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা সমূহ আবার দুইটি শাখায় বিভক্ত-মোন-খমের ও মুন্ডারী ।

১.১ মোন-খমের শাখাঃ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় একশটিরও অধিক ভাষা মোন-খমের শাখা-র অন্তর্ভূক্ত। এই ভাষাগুলি পূর্ব ভারত থেকে ভিয়েতনাম এবং ইউনান (Yunnan) থেকে মালয়েশিয়া ও আন্দামান সাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে রয়েছে খাসিয়া ভাষা।

১.১.ক খাসিয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী মঙ্গোলয়েড খাসিয়া জাতির ভাষা বর্তমানে প্রায় ১২,২৮০ জন লোকের মুখে প্রচলিত। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ লোক খাসিয়া ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে বার্মার মোঁয়ে (Mon), পলং (Palng) ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি জাতিসত্বা সমূহের ভাষার মিল দেখিয়েছেন বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকরা। খাসিয়া ভাষা মৌখিক ভাষা। এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খাসিয়াদের মধ্যে খ্রীষ্টীয় ধর্ম অনুপ্রবেশের পর এই ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসিয়া ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ সালের পরে ওয়েল্‌স মিশনারী দলের টমাস জোন্‌স রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। টমাস জোন্‌স কে এ জন্য খাসিয়া বর্ণমালার জনক বলা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি খাসিয়া ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসিয়া ভাষার উপভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁড়, লিংগাম, ওয়ার উল্লেখযোগ্য।

১.২ মুন্ডারী শাখাঃ অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ব্ববিদ মুন্ডারী শাখাকে অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবেচনা করলেও এর ভিন্ন মতও রয়েছে। Hevesy-i মতে এই Finno-Ugrian ভাষা গোষ্ঠীর কোন এক জাতি সুদূর অতীতে হয়ত ভারতবর্ষে চলে আসে এবং তাদের আনীত ভাষা পরবর্তীতে স্থানীয় অন্য কোন ভাষার প্রভাবে মুন্ডারী শাখার ভাষার সৃষ্টি করে। কিন্তু Finno-Ugrian ভাষা-ভাষীদের অতীতে ভারতবর্ষে আগমনের কোন হদিস এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই Hevesy-র মতামতকে নিশ্চিত বিবেচনায় না এনে আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত মুন্ডারী শাখার ভাষা সমূহের আলোচনা করা যাক-

১.২.ক সাঁওতালী ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় দুই লক্ষের মত সাঁওতাল বসবাস করে। তবে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধকোটি লোক সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। ডঃ ক্ষুদিরাম বাংলা ভাষার শতকরা পঁয়তাল্লিশ এবং সংস্কৃত ভাষার শতকরা চল্লিশ ভাগ শব্দই সাঁওতালী ভাষাজাত বলে উল্লেখ করেছেন। হাজার হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা এই সাঁওতালী ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খ্রীষ্টান মিশনারীদের হাতে সর্বপ্রথম সাঁওতালী ভাষার লিখিত রূপ দেওয়া হয় রোমান হরফে। জানা যায়, ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার লুথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে সাঁওতাল ভাষার ব্যাকরণ ও অনেক বই প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘূনাথ মুর্মূ কর্তৃক ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতালী বর্ণমালা তৈরী হয়েছিল এবং তার সরকারী স্বীকৃতিও মিলেছিল। তবে নানান কারনে তা টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ২০শে মার্চ রাজশাহী জেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামে সাঁওতালী ভাষা শিক্ষাদানের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে সুন্দরপুর বিদ্যালয়, জয়কৃষ্ণপুর বিদ্যালয় এবং সোনাডাইং বিদ্যালয় নামে আরো তিনটি সাঁওতালী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্যালয় গুলোতে মূলতঃ বাংলা হরফেই সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। কুরকু ও নাহিলি নামে সাঁওতালী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে।

১.২.খ মুন্ডা ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২১৩২ জন মুন্ডা বসবাস করে। মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগে পিজিন ভাষা হিসেবে মুন্ডা ভাষার প্রচলন হয়েছিল। মুন্ডা ভাষার কোন নিজস্ব হরফ নেই। ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে।

১.২.গ. বিন্‌ধ ভাষাঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোবরাতলা ইউনিয়নে বিন্‌ধ-দের বাস। অস্ট্রালয়েড এই বিন্‌ধ-রা মধ্য-পশ্চিম ভারতের বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। রিজলী ও ডাল্টন- এর মতে, বিন্‌ধ-রা ভারতের ছোট বিহার ও ছোটনাগপুর এলাকায় বসবাস করার সময় যে ভাষায় কথা বলত তা ছিল মুন্ডারী শাখার। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত বিন্‌ধ-রা বাংলা, হিন্দি, মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা বিলুপ্ত প্রায় বলা চলে।

১.২.ঘ. সিং ভাষা ঃ সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ইশ্বরদী, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৪০০০ জনের অধিক সিং রয়েছে। সিং জাতি আবার তিনটি শাখায় বিভক্ত-রওতিয়া সিং, গন্‌জু সিং, ও ভূমিজ সিং। এই তিনটি শাখার লোকজনের মুখের ভাষায় পার্থক্য রয়েছে। গন্‌জু সিং-দের ভাষার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে মাহাতোদের ভাষার সাথে। অন্যদিকে রওতিয়া সিং ও ভূমিজ সিং-দের ভাষায় কিছু পার্থক্য থাকলেও তা মোটামুটি একই ধরনের। সিং জাতি ভারতের রাঁচীতে থাকাকালীন যে সিং ভাষা ব্যবহার করত তা আর এখন অবিমিশ্র রূপে নেই ; বাংলা, হিন্দি, বিহারী ভাষার বিভিন্ন উপাদান ঢুকে এক মিশ্র ভাষার রূপ ধারন করেছে । সিং ভাষা-র কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই।

২. ভাষা পরিবার টিবেটো-চীনঃ ভাষাতাত্ত্বিকরা টিবেটো-চীন পরিবারের ভাষা সমূহের বিস্তৃতি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে বার্মা এবং বালিষ্টান থেকে পিকিং পর্যন্ত পূর্ব গোলার্ধের এক বির্স্তীণ অঞ্চল পর্যন্ত বলে উল্লেখ করেছেন। এই টিবেটো-চীন ভাষা পরিবার দুটি ভাগে বিভক্ত- শ্যামীজ-চাইনীজ, এবং টিবেটো-বর্মণ। টিবেটো-বর্মণ আবার দুইটি ভাগে বিভক্ত- একটি টিবেটো-হিমালয়ান ও অপরটি আসাম-বার্মীজ। আসাম-বার্মীজ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন- বোডো, নাগা, কুকী-চীন, কাচীন, বার্মীজ, সাক ইত্যাদি।

২.১ বোডো শাখাঃ আচিক, ককবরক, হাজং প্রভৃতি ভাষা সমূহ এই শাখার অর্ন্তভূক্ত।

২.১.ক. আচিক ভাষাঃ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, মধুপুর, সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে মান্দি (গারো) -দের বসবাস। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক এই মান্দি জাতির স্বীকৃত ভাষার নাম ‌আচিক ভাষা’ মান্দিদের মোট ১৩টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশে ৭টি গোত্রের অবস্থান রয়েছে। গোত্র ভেদে মান্দিদের আলাদা আলাদা উপভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বর্তমানে আচিক ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। তবে অতীতে এদের বর্ণমালা ও পুস্তকাদি ছিল বলে এক লোককাহিনী প্রচলিত আছে। জন থুসিন রিছিল, ডানিয়েল আর রুরাম , মার্টিন রেমা, প্রদীপ সাংমা নামের চার গবেষক আলাদা আলাদা গবেষণার মাধ্যমে চার ধরনের বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছেন। এগুলি নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মান্দিদের নিজস্ব সাহিত্য নিজস্ব বর্ণমালায় লিপিবদ্ধ সম্ভব হবে। তবে বর্তমানে রোমান এবং বাংলা হরফেই আচিক সাহিত্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বসবাসরত মান্দিরা আচিক ভাষাতেই পড়াশুনা ও সাহিত্য রচনা করে থাকে।

২.১.খ. ককবরক ভাষাঃ বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত প্রায় ত্রিশলক্ষ ত্রিপুরা এই ককবরক ভাষা-য় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শাসিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক ভাষা (= মানুষের ভাষা) প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম, চট্রগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লায় এই ককবরক ভাষাভাষীদের বসবাসরত দেখা যায়। মান্দিদের মতন গোত্র ভেদে এদেরও উপভাষা রয়েছে। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। তবে বাংলাদেশে ১৬ টি গোত্রের ১৬টি উপভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। অতীতে ককবরক ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল বলে লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক ভাষা বাংলা হরফেই লিখিত হয়ে আসছে। সেখানে ২০০০ সাল থেকে ককবরক ভাষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হলেও বাংলাদেশে এই ভাষার চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়নি। তবে সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ককবরক ভাষার সাময়িকী সমূহ বাংলা হরফেই লেখা হয়। বর্তমানে কেউ কেউ রোমান হরফে ককবরক ভাষা চর্চার চেষ্টা করছেন। ককবরক ভাষার ব্যাকরণ অনেক পুরাতন। ধারনা করা হয় প্রায় একশ বছর পূর্বেই ককবরক ব্যাকরণ রচিত হয়েছিল।

২.১.গ. হাজং ভাষাঃ বাংলাদেশে ময়মনসিংহের বিরিশিরি, শ্রীবর্দী, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় ১২০০০ হাজং তাদের নিজস্ব হাজং ভাষায় কথা বলে। ডঃ গ্রিয়ারসন হাজং ভাষাকে টিবেটো-বর্মন ভাষা হিসেবে দেখালেও ঐতিহাসিক হ্যামিল্টন-এর মতে হাজং-দের ভাষা বাংলা। হাজং ভাষায় অহমীয় ও কাছারী ভাষারও যথেষ্ট মিশ্রন ঘটেছে। হাজংদের ভাষার কোন নিজস্ব লিপি নেই। তবে বর্তমানে বাংলা বর্ণমালার সাথে একধরনের সাংকেতিক চিহ্ন প্রয়োগের মাধ্যমে হাজং ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানা যায়।

২.১.ঘ . লালেংঃ বাংলাদেশের সিলেট সদর থানা ও গোয়ানঘাট থানাদ্বয়ের অন্তর্ভূক্ত ২২/২৩ গ্রামে প্রায় ৪০২ টি পরিবারের ২০৩৩ জন আদিবাসী পাত্র সমপ্রদায়ের বসবাস। পাত্র-রা নিজেদের ভাষার নাম লালেং বলে এবং নিজেদের লালং জাতি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
২.২. কুকি-চীন শাখাঃ
এই শাখার ভাষা গুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে মৈতৈ মণিপুরী, লুসাই, লাইমি , খ্যাং, খুমি, কুকি, পাংখো ইত্যাদি।

২.২.ক. মৈতৈ বা মণিপুরী ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ভাষাগত দিক থেকে বৃহত্তর মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত - মৈতৈ মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতৈ মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতৈ ভাষা যা টিবেটো-চীন ভাষা পরিবারের কুকি-চীন শাখার অর্ন্তভূক্ত। আতোম্বাপু শর্মার মতে, মৈতৈ ভাষা প্রায় ৩৪০০ বছরের পুরনো একটি ভাষা। পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতৈ লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র (৩৩-১৫৪ খ্রীঃ) আমলে। তখন মৈতৈ ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বা-র (১৫৯৬-১৬৫১ খ্রীঃ) শাসনামলে আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর এক কপার প্লেটের উপর মৈতৈ বর্ণমালার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার এটাই প্রমান করে যে মৈতৈ বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল মহারাজ পাংখংবা-র অনেক আগে থেকেই। মৈতৈ বর্ণমালার বয়স অনেক পুরোনো হলেও এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ধারনা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় যে হাতে লেখা পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতৈ ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুন্‌থক (poireiton khunthok) এবং নুমিত কাপ্পা (Numit kappa) অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্টীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতৈ মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে আসছে। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া লিপি পুনরুদ্ধার ও তা নিয়ে সাহিত্য-সাময়িকী রচনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী নামাঙ্কিত। যেমনঃ বাংলাক এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা ইত্যাদি।

২.২.খ. খুমি ভাষাঃ প্রায় দেড় হাজারেরও অধিক খুমি বান্দরবান জেলায় এবং থান্‌চি উপজেলায় বসবাস করে থাকে। খুমি-দের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে খুমিদের প্রায় সবাই তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেন না।

২.৩ সাক-লুই শাখাঃ
২.৩.ক. চাক (Chak)t মঙ্গোলয়েড চাক-রা নিজেদেরকে পরিচয় দেয় আসাক্‌ (Asak) বলে। বর্মীরা চাকমা ও চাক উভয় জনগোষ্টীকেই সাক্‌ (Sak) বা থেক্‌ (Thak) বলে থাকে। তবে পার্বত্য চট্রগ্রামের দক্ষিণে বাইশারি, নাক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গাতে প্রায় আড়াই হাজার চাক বাস করে যাদের ভাষা চাকমা ভাষার থেকে আলাদা। চাকমা ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের হলেও চাকদের ভাষা তিব্বতী-চীন পরিবারের। চাক বা আসাক্‌ (Asak) ভাষার সাথে উত্তর বার্মার কাডু (Kadu), গানান (Ganan) জনগোষ্ঠীর ভাষার মিল পাওয়া যায়। চাক ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে চাকদের লোক সংস্কৃতি বিভিন্ন লোকগাথাঁ, ধাঁধাঁ, লোকগীতি ইত্যাদি বেশ স্বয়ংসম্পূর্ন।

২.৩.খ. ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষাঃ বর্তমানে বাংলাদেশে ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০। ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে শরনার্থী আরাকানরাজ বল­ালরাজার সাথে মনতং (Mon-Tong) জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের আনীত ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা। লোকচিকিৎসা (ethno-medical) পেশার সাথে সম্পৃক্ততার দরুন কালক্রমে এরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাইদ্যা বা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মনতং বা বেদেরা নিজ জাতির লোকদের মধ্যে ঠার ভাষা ব্যবহার করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। ঠার ভাষা-র নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও এদের লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা -র বার্মা, চীন, লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উত্তর বার্মায় থেক, সাক, আসাক ইত্যাদি সবগুলোকেই কাডু ভাষার অন্তর্গত বলে ধরা হয়।

২.৪.বার্মীজ শাখা :
২.৪.ক . রাখাইন ভাষা : কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রায় দেড়লক্ষেরও অধিক লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। জানা যায় খ্রীষ্ট পূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে রাখাইন রাজা মারায়ু কর্তৃক রাখাইন প্রে বা রাখাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত রাখাইন ভাষা ছিল ঐ রাজ্যের একমাত্র জাতীয় ভাষা। রাখাইনদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। রাখাইন বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা হল ১২টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যেঃ মোট ৩৩টি। রাখাইন ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে স্বরবর্ণ© এবং পরে ব্যাঞ্জন বর্ণ শেখানো হয়। নিকট অতীত কালেও ক্যং-এ রাখাইন ভাষা শেখানোর প্রথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে তা কেবল পারিবারিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। তারপরও বর্তমানে রাখাইনদের শতকরা প্রায় ৭০ জনেরও বেশী লোক নিজ ভাষায় লিখতে ও পড়তে সক্ষম।

৩. ভাষা পরিবার-দ্রাবিড়ঃ দ্রাবিড় শব্দটি প্রসারিত অর্থে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের এক বিশাল ভাষা পরিবার। আযর্-দের আগমনের বহু পূর্বেই এই দ্রাবিড় ভাষা সমূহ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের মধ্যে কুড়ুখ বা ওঁরাও, পাহাড়িয়া, মাহালি প্রভৃতি ভাষা প্রচলিত।

৩.ক. ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষাঃ লালমণিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও পাবনা ব্যতীত উত্তরবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলাতেই ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষা-ভাষীদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ এদের মোট সংখ্যা প্রায় ৬৫০০০ জন। কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও অবিমিশ্র এবং এটি দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় বসবাসরত ওরাঁওরা ব্যবহার করলেও সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলের ওঁরাওরা মূলত কুড়ুখ্‌, উড়িয়া, উর্দ্দূ, হিন্দী, ফার্সী ও বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে । কুড়ুখ ভাষা মূলত কথ্য ভাষা। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা তৈরি হয়নি।

৩.খ. পাহাড়িয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুরে প্রায় ৭৩৬১ জন পাহাড়িয়া জাতির লোক বাস করে। পাহাড়িয়া জাতির দুটি শাখা রয়েছে। এদের একটি শাওরিয়া পাহাড়িয়া বা মালের এবং অন্যটি মাল পাহাড়িয়া বা মালো। বাংলাদেশে মাল পাহাড়িয়া-দের সংখ্যা কম। সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায়, অতীন্দ্র মজুমদার সহ অনেকেই মালপাহাড়িয়া-দের ভাষাকে মাল্‌তো বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ডঃ শিবানী রায়ের মতে এদের ভাষার নাম বাড়লা, যা আসলে মিশ্র ভাষা এবং দীর্ঘদিন বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে তা হয়েছে। আবার সুবোধ ঘোষ মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে বাংলা ভাষার অপভ্রংশ হিসেবে দেখিয়েছেন। শাওরিয়া পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে কেউ কেউ পল্লী ভাষা হিসেবে দেখিয়েছেন যা কিনা শাদ্‌রি-র খুব কাছাকাছি। যা হোক শাওরিয়া ও মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। মূলত ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা তার অতীত ঐতিহ্যগাঁথা ধরে রাখতে পেরেছে।

৩.গ. মাহালি ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মাহালি নামের জাতিগোষ্ঠির ভাষার নাম মাহালি ভাষা, যা দ্রাবিড় ভাষা পরিবার ভুক্ত। বর্তমানে এরা মূলতঃ বাংলা ভাষাতেই কথা বললেও এদের কথ্য ভাষায় আজও মূল মাহালি ভাষার কিছু কিছু শব্দাবলীর প্রচলন রয়ে গেছে। যেমন- দাস্‌ (পানি), দাকা (ভাত), গুড়া (ঘর), দানড়ী (গরু) ইত্যাদি।

৪. ভাষা পরিবার-ইন্দো-এরিয়ান : নর্ডিক (Nordic) এবং আলপীয় (Alpine) নামের দুই ভিন্ন নরগোষ্ঠী ভারতবর্ষে আর্য ভাষার প্রবর্তন করেছিল। নর্ডিক-দের রচিত ঋগ্বেদের ভাষাই আর্য ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। ঋগ্বেদের ভাষা তথা বৈদিক ভাষা পরবর্তিতে ব্যাকরণবিদদের হাত ধরে সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। কালক্রমে এই সংস্কৃত ভাষা লোক মুখে বিকৃত হতে হতে প্রাকৃত ভাষার রূপ নেয়। এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের উৎপত্তি। বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত কয়েকটি ভাষার পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল-

৪.ক. চাকমা ভাষাঃ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির মধ্যে চাকমা-রা সংখ্যায় সর্বাধিক (প্রায় তিন লক্ষ)। পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত এই চাকমা জাতির নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে, রয়েছে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা। এ বর্ণমালার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বর্মী ও অসমীয় বর্ণমালা। অতীতে চাকমা লিপিতেই চাকমা সাহিত্য রচিত হত। খ্রীষ্টান মিশনারিরাই সর্বপ্রথম ১৮৮৬ সালে ভারতের এলাহাবাদের এক ছাপাখানা হতে চাকমা লিপিতে ও চাকমা ভাষায় অনূদিত বাইবেল প্রকাশ করে। ত্রিশ বা চল্লিশের দশকে হরকিশোর চাকমা কর্তৃক চাকমা লেখা নামক বই চাকমা লিপিতে প্রকাশিত হয়।

৪.খ. রাজবংশী ভাষাঃ প্রায় সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক রাজবংশী রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরে বাস করে। ধারনা করা হয় রাজবংশী ভাষা একসময় বৃহত্তর বোডো (Bodo) ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও রাজবংশীরা বোডো ভাষা হারিয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে; তবু এখনো রাজবংশী ভাষার ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ঙ, ং এর উচ্চারণ, বোডো ভাষার উৎসজাত শব্দাবলী এবং বোডো ভাষার অপভ্রংশ লক্ষ্য করা যায়।

৪.গ. মাহাতো ভাষাঃ মাহাতো জাতির নিজস্ব মাহাতো ভাষা বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক লোক ব্যবহার করে। এদের বসবাস সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ এবং বগুড়া জেলার শেরপুর থানার অর্ন্তগত গ্রাম গুলোতে। মাহাতোরা নিজেদের ভাষাকে নাগ্‌রী ভাষা বলে উল্লেখ করে। মাহাতোদের ভাষাকে কেউ কেউ শাদ্‌রি ভাষাও বলে থাকেন। মাহাতো ভাষায় হিন্দী, উর্দ্দূ, বাংলা, অহমীয়া ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। মাহাতো ভাষার নিজস্ব কোন হরফ নেই।

৪.ঘ. বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-দের বসবাস সিলেট বিভাগে। আগেই বলা হয়েছে জাতিগত ভাবে এক হলেও মণিপুরী জাতি ভাষাগত ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে- এদের একটি রাজার গাঙ (= রাজার গ্রাম) এবং অপরটি মাদাই গাঙ (= রানীর গ্রাম)। ডঃ কে পি সিন্‌হা-র মতে নব ইন্দো-আর্য ভাষার উৎপত্তি কালে বা সামান্য পরে অর্থাৎ ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে ইন্দো-আর্য ভাষার থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র‌ ভাষা হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা সর্বপ্রথম ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত হয়ে থাকে। এই নব্যপ্রচলিত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ষোড়শ শতাব্দীতে। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ট সংস্পর্শের কারনে এসময় বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার ব্যাপক মৈতৈ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-রা মণিপুর ছেড়ে ত্রিপুরা, আসাম ও বাংলাদেশের সিলেটে আশ্রয় গ্রহন করে। এসময় কালেই মূলতঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় ব্যাপক ভাবে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের শব্দাবলী প্রবেশ করে। অহমিয় ও বাংলা ভাষার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলীর মিল থাকার কারনে অনেকেই এই ভাষাকে অহমিয় ও বাংলা-র একটি উপভাষা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। ডঃ কে. পি. সিন্‌হার মতে এই বৈশিষ্ট্যগত মিল সম্ভব হয়েছে বাংলা, অহমিয় ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উৎপত্তি একই উৎস থেকে (মাগ্‌দী প্রাকৃত) বলে।

বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহ সবসময় বৃহত্তর জাতির ভাষার চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহত্তর জাতির ভাষা বা তাদের সুবিধা মতন অন্য কোন ভাষা প্রধান হয়ে উঠবার এবং জোড়পূর্বক একভাষিকতা চাপানোর একটা অসৎ প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই প্রবনতার মাত্রা অত্যন্ত প্রকট ও খোলামেলা রূপেই দেখা যায়। যদিও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও রুশ ভাষার জৌলুস এবং আধিপত্যের কাছে লেট্‌, এস্তোনিয়া সহ অন্যান্য ভাষা গুলোর অবস্থা ছিলো অত্যন্ত ম্রিয়মান। আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের অবস্থা অত্যন্ত কোনঠাসা। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের সবগুলোই মূলতঃ দ্বি-ভাষী (Bilingual) নিজ পরিবার বা নিজ জাতিসত্ত্বার ভিতরে এরা নিজ মাতৃভাষায় কথা বললেও বাইরের কারো সাথে এরা বাংলাতেই কথা বলে। অনেক গুলি জাতিসত্ত্বা নানাবিধ কারনে আজ তাদের নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। এদের মধ্যে বিন্‌ধ, কোচ, রাজবংশী, পাহাড়িয়া, হো, বর্মন, ইত্যাদি উল্লে­খযোগ্য। সত্তরের দশকে চাকমা ও মারমা-রা ক্যং-এ তাদের নিজস্ব লিপিতে নিজ নিজ ভাষার চর্চা করত। বিভিন্ন কারনে আজ সেই ব্যবস্থাও বন্ধ। নতুন প্রজন্মের চাকমা-রা আজ আর তাদের নিজ বর্ণমালার সাথে পরিচিত নয়। মাহালি, বুনো, বাগদী জাতিসত্ত্বার লোকজন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে অক্ষম। মনতং বা বেদে-দের ঠেট বা ঠার ভাষা তার নিজস্ব উপাদান হারাতে হারাতে রিক্ত হতে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অভাবে মণিপুরী, ককবরক, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও ভাষা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে পা বাড়াচ্ছে। এই হচ্ছে আজ বাংলাদেশের ভাষা সমূহের সামগ্রিক চিত্র। এই যে ভাষা গুলির হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংসের প্রান্তিক সীমায় অগ্রসর হওয়া তা শুধু মাত্র একেকটি ভাষার হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্ব চিহ্নমাত্র নয়; এই হারিয়ে যাওয়া হল একেকটি জাতিসত্তার নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, লোকায়ত জ্ঞান, সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া। আর কোন জাতির এগুলি হারানোর অর্থ হল পৃথিবীর বুক থেকে সেই জাতির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাওয়া। ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মূল লক্ষ্য হল পৃথিবীতে ভাষার বহুত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। যে বাঙালি জাতিকে ১৯৫২ সালে চরম আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল নিজ মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য, সেই জাতির রাষ্ট্রভূমিতে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্ত্বা সমূহের ভাষা গুলোর যে করুন অবস্থা তা সত্যিই লজ্জাজনক, দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৩৩ বছর পরেও এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের সংরক্ষণ, উন্নয়নের ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ তো নেয়েইনি বরং এই সমস্ত ভাষা সমূহের অধিকারী বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বও স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের নিজ মাতৃভাষাতে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই মণিপুরী, খাসিয়া, মান্দি, সাঁওতাল সহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করছে। এখনএকুশে-র অহংঙ্কার ধারনকারী এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি পারবে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপস্থিত এই সমস্ত ভাষা গুলি রক্ষার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ? তার বিশাল ভাষা জাদুঘরকে জীবন্ত রাখতে ? নাকি আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অধিকারী এই বাংলাদেশ হারাবে তার ভাষার বৈচিত্র্যতাকে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে ?

উল্লেখ্যপঞ্জি ঃ
গ্রন্থ সমূহঃ
১. Chittagonj Hill Tracts- R. H. Sneyd Hutchinson Vivek Publishing company, DelhiFirst Published 1901, Reprint 1978 .
২. The peoples of India- Anderson, J.DBimla pub. ।। First Published 1913.
৩. An Etymological Dictionary of Bishnupriya Manipuri- Dr. K. P. Sinha Puthi, Calcutta 1986.
৪. ভাষাতত্ত্ব - অতীন্দ্র মজুমদার।। নয়াপ্রকাশ, কলিকাতা।। ১৯৯৭।
৫. ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। রূপা অ্যান্ড কোম্পানী, কলিকাতা, জানুয়ারী ১৯৯২।
৬. ভারত সংস্কৃতি- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃলিঃ কলকাতা।। আষাঢ় ১৪০৪।
৭. ভারতের আদিবাসী- সুবোধ ঘোষ।। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।। b‡f¤^i ২০০০।
৮. ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়- ডঃ অতুল সুর।। সাহিত্যলোক, কলকাতা।। জুলাই ১৯৮৮।
৯. ভাষা, দেশ, কাল- পবিত্র সরকার।। জি.এ.ই. পাবলিশার্স।। বৈশাখ ১৩৯২।
১০. উপভাষা চর্চার ভূমিকা- মনিরুজ্জামান।। বাংলা একাডেমী, ঢাকা।। মে, ১৯৯৪।
১১. ককবরক ভাষা ও সাহিত্য- কুমুদ কুন্ডু চৌধুরী।। অক্ষর পাবলিকেশান্‌স, আগরতলা।।
১২. পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতীয় ভাষা- সুগত চাকমা।। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট।। রাঙ্গমাটি।। মার্চ ১৯৮৮।
১৩. বাংলাদেশের গারো সমপ্রদায়- সুভাষ জেংচাম।। বাংলা একাডেমী. ঢাকা।। ১৯৯৪।
১৪. চাকমা পরিচিতি- সুগত চাকমা।। বরগাঙ পাবলিকেশন্স, রাঙ্গামাটি।। অক্টোবর ১৯৮৩।
১৫. বাংলাদেশের সাঁওতালঃ জীবন ও সংস্কৃতি- আখতার উদ্দিন মানিক।। উত্তরা প্রকাশনা ,মোহাম্মদপুর,ঢাকা।। wW‡m¤^i ১৯৯৮

১৬. উত্তরবঙ্গের আদিবাসীঃ লোকজীবন ও লোকসাহিত্যঃ ওঁরাও- ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল জলিল।। বিশ্ব সাহিত্য ভবন, ঢাকা।। মে ২০০১।
১৭. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ নদীয়া জেলা- ডঃ শিবানী রায় (মওল)।। পুস্তক বিপনি, বেনিয়াটোলা লেন, কলিকাতা।। অক্টোবর ২০০২।
১৮. সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র- ডঃ রতন লাল চক্রবর্তী।। মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।। মে ২০০০।
১৯. বাংলাদেশের মণিপুরীঃ ত্রয়ী সংস্কৃতির ত্রিবেনী সঙ্গমে- এ কে শেরাম।। আগামী প্রকাশনী; ঢাকা।। ১৯৯৬।
২০. বাংলাদেশে রাখাইন সমপ্রদায়ঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা-মং বা অং (মং বা)।।প্রকাশক-লেখক।।এপ্রিল ২০০৩ খ্রী.।
প্রবন্ধ/পত্রিকাঃ
১. হাজং জীবনের ইতিবৃত্ত- মুজিব মেহেদী।। বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীঃ অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত- সম্পাদনাঃ হাফিজ রশীদ খান।। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।। ১৯৯৩।
২. বরেন্দ্র অঞ্চলের বিন্‌ধ জাতিগোষ্ঠীঃ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় উদ্‌ঘাটন- ডঃ মোঃ আব্দুর রশীদ সিদ্দিকী।। আইবিএস জার্নাল।। ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।। ১০ম সংখ্যা ১৪০৯
৩. মানুষ- সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ মহসীন।। এফআইভিডিবি, খাদিমনগর, সিলেট।। †m‡Þ¤^iÑ অক্টোবর ১৯৯৭।




.......................................................................................................







পীরেন স্নাল ও ইতিহাসের বিদ্রোহী আত্মারা


দুপুর মিত্র

পীরেন স্নাল যখন শহীদ হলেন তখন থেকেই আমার ভিতরে জেগে উঠেছিল বিদ্রোহীরা। ইতিহাসের পাতা থেকে করুন অথচ ক্রোধান্বিত কিছু মুখ কি যেন বলতে চেয়ে প্রায়ই হারিয়ে যেত। আজো তাঁদের খুঁজে বেড়াই। সেই মুখ কি যেন বলতে চেয়েছিল-।

যে পীরেনকে মারা হলো, যে পীরেনকে শহীদ হতে হলো ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে, রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়ন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে, সেই পীরেনের মত অতীতে না জানি কত মান্দি, হাজংকে প্রাণ দিতে হয়েছে এইসব নানান জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে।

হিন্দু জমিদারগন মান্দিরাজ্য দখল করার পরপরই জুলুম-নির্যাতন শুরু করে। তখন মান্দিদের জীবিকার একমাত্র উপায় ছিলো কৃষিকাজ। জুম পদ্ধতিতে এরা কৃষিকাজের মাধ্যমে প্রধানতঃ উৎপাদন করত ধান ও তুলা। সমতল ভূমির বাজারে এসেই এরা জমিদার ও ব্যবসায়ীদের শোষণের শিকার হয়। সামান্য লবনের বিনিময়ে মান্দিদের কাছ থেকে কেড়ে নিত বিপুল পরিমান তুলা। এছাড়া অন্যান্য দ্রব্যাদি যা সমতল ভূমির বাজারে নিয়ে আসা হত বিক্রির জন্য, তার উপর রাখা হত অতি উচ্চ হারের কর। মান্দিরা এইসব উৎপীড়নের বিরোধীতা করলেই জমিদাররা আরো অত্যাচার চালাত। এবং এই কারনেই শোষিত-নির্যাতিত এইসব মান্দি কৃষক বিদ্রোহীরা মাঝে মধ্যেই সংঘবদ্ধ হয়ে সমতলভূমিতে এসে জিনিসপত্র লুন্ঠন করে নিয়ে যেত।
এমনকি জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মান্দি ও হাজং জাতির লোকেরা করম শাহ নামক এক ব্যক্তির সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের শ্লোগানে সংঘবদ্ধ হয় নানা জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্যই।

ছপাতি নকমা মান্দি রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন জমিদারদের হাত থেকে মান্দি, হাজং, কোচ, মেচ, হাড়ি, ডালু প্রভৃতি জাতিসত্ত্বার লোকদের রক্ষা করার জন্য। তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তাঁর কারনেই ১৮০২ খৃষ্টাব্দের পর থেকে মান্দি সমাজে নানা পরিবর্তন ঘটেছিলো। অন্যদিকে করম শাহর মৃত্যুর পর থেকে টিপু গারো পাগলপন্থী মত প্রচার করেন। টিপুর নেতৃত্বে এখানে ১৮২৫-১৮২৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পাগলপন্থী বিদ্রোহ ঘটে। পাগলপন্থী বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার কারন ছিল বেশ স্পষ্ট। ১৮২০ সনে সেরপুরের জমিদারি বাটোয়ারা হইয়া গেলে, জমিদারগন প্রজা হইতে বাটোয়ারার খরচ আদায় মানসে বর্ধিত হারে খাজনা ধার্য করেন। জমিদার প্রজাসাধারণের নিকট আবোয়ার,খরচা,মাথট প্রভৃতি বহুবিধ ট্যাক্‌স ধার্য করিয়া প্রজার উপর উৎপীড়ন আরম্ভ করেন। এই উৎপীড়ন সহ্য করতে না পারিয়া বহু প্রজা জমিদারের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়। তাহারা কুড় ( সেরপুর পরগনার ১ কুড় = ৩ বিঘা ১০ কাঠা) প্রতি চারি আনার অধিক খাজনা দিতে পারিবে না বলিয়া ঘোষণা করে। ধর্ম প্রচারক টিপু সময় বুঝিয়া বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এবং স্বীয় অভিনব সাম্যমতের প্রচারের দ্বারা সেরপুরে ভীষণ বিপ্লব জাগাইয়া তোলে । কিন্তু এই সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে নতুন রাজ্য স্থাপন করলেও তাঁরা ২ বছরের অধিক সময় থাকতে পারেননি ইংরেজ সৈন্যদের হাতে পরাজিত হয়ে।

১৮৩২-৩৩ খৃষ্টাব্দে অবশ্য দ্বিতীয় পাগলপন্থী বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। টিপুর সহযোদ্ধা গুমানু সরকার ১৮৩২ সালে মান্দিদের দলপতি রূপে সংগ্রামে অংশ নেন। উজির সরকার নামে আরো একজন মান্দি গুমানু সরকারের সাথে কাজ করেন। ১৮৩৩ সালে জানকু পাথাং ও দুবরাজ পাথাং বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা শেরপুর আক্রমণ করে জমিদারদের গৃহ ও কাছারী বাড়ি লুন্ঠন করেন। এভাবে তাঁরা অনেকবার আক্রমণ করেন। এমনকি ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে বহু শত্রু সৈন্য ধ্বংস করেন। এদিকে মান্দিদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজরা উঠে পড়ে লাগে। না পেরে জানকু পাথাং ও দুবরাজ পাথাং কে ধরে দেওয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করে। নানান ভাবে ইংরেজ কর্তৃক নিপীড়নের ফলে মনোবল ভেঙ্গে যায় অনেক বিদ্রোহীর। এর কারনে দ্বিতীয় পাগলপন্থী বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়। নিখোঁজ হয় জানকু পাথাং ও দুবরাজ পাথাং।

এরকম আরো বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ১৮৩৭, ১৮৪৮, ১৮৬১, ১৮৬৬, ১৮৭১, ১৮৮২ খৃষ্টাব্দের বিদ্রোহ। ইতিহাসের এইসব বিদ্রোহের বিদ্রোহী আত্মারা কিছুই কি বলেনা ? কিছূই কি বলে না আক্রমণ-বিদ্রোহ-জেগে উঠার কথা ?

জমিদারদের জুলুম-নির্যাতনের কবলে পড়ে ক্ষিপ্ত মান্দি জাতিসত্ত্বার মানুষেরা জমিদারদের বিভিন্ন ঘাঁটি ও কর্মচারীদের উপর আক্রমণ আরম্ভ করে ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের দিকে। এসময় ইংরেজ সৈন্যদের সাথে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে এই সংগ্রাম শক্তিশালী হয়ে উঠলে মান্দিরা কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারী সৈন্যবাহিনীর ভয়ে মান্দিরা পলায়ন করলেও জমিদারদের উপর আক্রমণ তারা অব্যাহত রেখেছিল। আক্রমণের ফলস্বরূপ মান্দিদের ন্যায্য অধিকার প্রদানের পরিবর্তে সরকারের পরামর্শে মান্দি অঞ্চলের বাজার বন্ধ করে দেয়। কিন্তু হিতে বিপরীত ঘটে। আক্রমণ আরো বৃদ্ধি পায়। এতে করে কিছুদিন জুলুম-নির্যাতন বন্ধ থাকলেও ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে ইংরেজ সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে ঢুকে লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালায়। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে সুসঙ্গের জমিদার আবারও খাজনা আদায়ের চেষ্টা করে। বিক্ষুদ্ধ মান্দিরা দলবদ্ধ হয়ে সমতলে এসে জমিদার ঘাঁটি গুলোর উপর আক্রমণ চালিয়ে যায়। এই আক্রমণে অনেক পাইক-বরকন্দাজ ও কর্মচারি নিহত হয়। এই অবস্থায় সৈন্যরা স্থায়ীভাবে মান্দি এলাকায় বসবাস শুরু করলে বিদ্রোহ কিছুটা থেমে থাকে। এ থেমে থাকার মানে এই নয় যে এরা ইংরেজ ও জমিদারদের জুলুম মেনে নিয়েছিল। ভিতরে ভিতরে আক্রমনের সুযোগ খুঁজছিল মান্দিরা। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে জরিপ কাজের জন্য ইংরেজরা মান্দি এলাকায় প্রবেশ করলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। এতে ইংরেজরা প্রতিশোধ নেবার জন্য অনেক মান্দি ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। বিপুল সংখক ইংরেজ সৈন্যদের কাছে শেষ পর্যন্ত আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হয়। ১৮৭১ খিস্টাব্দের বিদ্রোহে মান্দিদের পরাজিত করানোর পর ১৮৮২ খিস্টাব্দে আঠারখানি গ্রামের মানুষদের পথঘাট নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করে ইংরেজরা। কিন্তু এই সময়ে দুর্ব্যবহারের কারণে কাজ করা বন্ধ করে দেয় মান্দিরা। তখন বিদ্রোহ দেখা দেয়। মান্দিরা তীর-ধনুক দিয়ে সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে।

মান্দি, হাজং, ডালু, বানাই প্রভৃতি জাতিসত্ত্বার মানুষেরা টঙ্ক আন্দোলনেও যুদ্ধ করেছিল। টঙ্ক প্রথা হলো ফসলে খাজনা দেয়ার ব্যবস্থা। জমিতে ধান হোক বা না হোক খাজনা দিতেই হবে। এই টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে নানান ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার মানুষেরা গড়ে তোলে সশস্ত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে নারীদের ভূমিকাই ছিল বেশি। রাশিমণি হাজং টঙ্ক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন অনেক হাজং নারীদের। জমিদার গোষ্ঠী ও বেস্টিন বাহিনীর সশস্ত্র দল ফসলের সাথে মেয়েদরও লুট করে। কুমুদিনী হাজং নামে এক কিশোরী বধূকে টেনে-হিঁচরে তুলে নেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাশিমণি হাজং এর নেতৃত্বে মেয়েরা দা, বটি, বল্লম, কোঁচ প্রভৃতি অস্ত্র হাতে কুমুদিনী হাজংকে উদ্ধার করতে যান। এই সময়েই সিমসাং নদীর তীরে বেস্টিন বাহিনীকে আক্রমন করেন হাজংরা। রাশিমণি হাজং দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন বৃটিশ পুলিশ। সে সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রাশিমণি হাজং। রাশিমণি হাজং ছাড়াও আন্দোলনে ছিলেন অশ্বমণি হাজং, যাদুমণি হাজং সহ অনেক অবিসংবাদী নেত্রী।

এই সব ইতিহাসের আত্নারা আজও কিছু বলতে চায়। আমরা কি শুনতে পাই ?

সুসঙ্গ জমিদার বংশের রাজা কিশোরের আমলে ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে হাতি ধরার কাজের জন্য অনেক হাজং পরিবারকে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে আসে। তখন থেকেই হাজংগণ নিজেদের চাষবাস বন্ধ করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে হাতির খেদা পেতে হাতি ধরত। এই হাতি বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করত জমিদারেরা। হাজং চাষীরা গহীন অরণ্যের মধ্যে গজারি গাছের খুঁটি দিয়ে একটি বড় স্থান বেষ্টনী করে মধ্যে হাতির প্রিয় খাবার কলাগাছ ও ধানের চাষ করে রাখত। খাবারের লোভে বন্যহাতিরা খেদার মধ্যে আসলে প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হতো। এভাবে হাতি ধরতে গিয়ে অনেক হাজংকেই প্রাণ দিতে হয়েছিল। হাজংরা ইচ্ছে করলেই এই কাজে না করতে পারত না। একসময় হাজংরা এই বাধ্যতামূলক বেগার প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করল। মনা সরদারের নেতৃত্বে গড়ে উঠল আন্দোলন। বুনো হাতির পদতলে পিষে মনা সরদারকে হত্যা করলে আরো বেশী ক্ষেপে যায় হাজংরা। এই আন্দোলনে মান্দিরাও যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহের মুখে পড়ে জমিদার পরিবার পালিয়ে যায়। সে সময় বাধ্যতামূলক হাতি খেদার কাজ বন্ধ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল রাতিয়া হাজং, মংলা হাজং, বেহারী হাজং, বাঘা হাজং, জগ হাজং ও সোয়া হাজংদের।

একসময় সুসং, মদনপুর, জংগলবাড়ি, শেরপুর প্রভৃতি এলাকা শতাব্দীর পর শতাব্দী বংশানুক্রমে রাজত্ব করত মান্দি সর্দারেরা। বাইস্যা মান্দা নামের একজন সর্দারের রাজত্ব ১২৮০ সালে সোমেশ্বর পাঠক (সিং) দখল করে নেয়। এই সময়েই বেশ কিছু হিন্দু জমিদারের উদ্ভব ঘটে। হিন্দু জমিদাররা নানা ভাবে মান্দিদের-হাজংদের-কোচদের-ডালুদের-মেচদের-বানাইদের-হদিদের-হাড়িদের-বংশীদের উপর অত্যাচার চালাত। কখনো লবনের সরবরাহ বন্ধ করে দিত, আবার কখনো সমতলের বাজারে কোনও পণ্যদ্রব্যাদি নিয়ে আসলে অধিক হারে মাশুল আদায় করত। কিন্তু হিন্দু জমিদারেরা তেমন কিছু না পারলেও ইংরেজরা আসার পর নানান জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্দোলন দমিয়ে রাখা হত।
আজো এই দমিয়ে রাখার প্রবণতা রয়ে গেছে। এখন আরো জটিলভাবে-অনেক বেশি শোষণের মাধ্যমে। এর জলজ্যন্ত প্রমান পীরেন স্নালের খুন হওয়ার ঘটনা। মান্দিরা কি এমন ক্ষতি করেছিলো বনবিভাগের-রাষ্টের। ওদের মত করে বাঁচতে চেয়েছিল; এইতো। এতদিন যাবৎ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য বাঁচতে চেয়েছিল ওরা ওদের মত করে-তাও কি দেয়া হবেনা ? ও, এখন কেবল বাকি রয়ে গেছে ওদেরকে চিড়িয়াখানায় ভরা ? কিন্তু না; এইসব জুলুম আর নির্যাতনের মাঝে যে সব হাজারো বিদ্রোহী জেগে উঠেছিল অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, সেইসব বিদ্রোহীদের আত্মা ডেকে তুলবেন পীরেন স্নাল। আমি সেই আত্মাদের কথা শুনছি।
উল্লেখঃ
১.বাংলাদেশের গারো সমপ্রদায়, সুভাষ জেংচাম, ১ম প্রকাশ জুন ১৯৯৪, বাংলা একাডেমী।
২.ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, সুপ্রকাশ রায়, ১ম প্রকাশ জুলাই ১৯৬৬, ডিএনবি ব্রাদার্স।
৩.বাংলাদেশের কৃষক বিদ্রোহ, অজয় রায়, প্রকাশকাল ১৯৮৫, বাংলা একাডেমী ।
৪.বিপন্ন্‌ ভূমিজ অস্তিত্বেও সংকটে আদিবাসী সমাজ বাংলাদেশ ও পূর্বভারতের প্রতিচিত্র, সম্পাদনা-মেসবাহ কামাল ও আরিফাতুল কিবরিয়া, প্রকাশকাল-২০০৩, গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ


............................................................................................................................................


নারী মুক্তিঃ প্রেক্ষিত জুম্ম নারী সমাজ


ভেঘাত্যা চাকমা


নারী মুক্তি শব্দটি বহুল আলোচিত, সমালোচিত, সুপরিচিত। সময়ের দাবিতে বিশ্বব্যাপী এর সংজ্ঞা-স্বরূপ বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সন্দেহ নেই সামগ্রিক প্রেক্ষিতে নারী মুক্তি যে অর্থ বহন করে তার যর্থাথতা বিচারে স্বতন্ত্র‌ এবং গূঢ় তাত্ত্বিক আলোচনা-গবেষণা প্রয়োজন। এটা অনস্বীকার্য© যে, নারী মুক্তির অর্থ সমাজের সামগ্রিক মুক্তি। তাই নারী পুরুষের সম উন্নয়ন কোন অনুগ্রহের বিষয় নয় বরং যে কোন সমাজের অগ্রগতির জন্য এটি অপরিহার্য। বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, দেশে বিরাজমান বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রামে নারী বিশেষত জুম্ম নারীদের অবস্থান আদৌ সন্তোষজনক নয়। কারন জুম্ম নারী সমাজও নারী-পুরুষ বৈষম্যের প্রভাবমুক্ত নয়। নারীর উপর বৈষম্য-নিপীড়ন-নির্যাতন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে ঘটলেও আমাদের দেশে সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্যাঞ্চলে নারী নির্যাতন-নিপীড়ন-বৈষম্যের চিত্র-প্রেক্ষাপট সংগত কারনেই একটু ভিন্ন। আর পার্বত্যাঞ্চলে জুম্ম নারী মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্য কী ব্যক্তি বিশেষ, নাকি ধর্ম-বর্ণ-সমপ্রদায়-জাতিগত পরাধীনতা থেকে মুক্তি তা স্পষ্ট নয়।

একজন নারী কন্যা, বোন, স্ত্রী, মাতা রূপে পরিপূর্ণ মানুষ। কিন্তু অপরাপর সমাজের ন্যায় আমাদের জুম্ম সমাজেও নারীদের অবদানকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা হয়না। শহরাঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে গ্রামাঞ্চলে জুম্ম নারীরা পায়না তাদের প্রাপ্য সম্মান, সুযোগ, শান্তি ও স্বস্তি । এজন্য পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থা, পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানে নারী-পুরুষের অসামঞ্জস্যতা, রক্ষণশীলতা, তথাকথিত মূল্যবোধ, নারীর মানবিক অধিকারের গুরুত্বহীনতা, শিক্ষার অনগ্রসরতা দায়ী। পাশাপাশি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক চাপ অনেকক্ষেত্রে জুম্ম নারীদের উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ না দিয়ে দূর্বল করে রাখার ইন্ধন যোগায়। বৃহত্তর রাজনীতির কৌশলগত কারনে তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা দিয়ে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। নারীদের মধ্যে মুক্ত চিন্তার উদয় হলেও পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চাপের কারনে তার অপমৃত্যু ঘটে। যার কারনে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমায়, অভিজ্ঞতায়, মননের উৎকর্ষতায় জুম্ম নারীরা অনেক পিছিয়ে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে জুম্ম নারীদের স্বত:স্ফূর্ত© অংশগ্রহন আশাব্যঞ্জক নয়। শিল্প, সাহিত্য, গবেষণা ক্ষেত্রে জুম্ম নারীদের অংশগ্রহনও খুবই নগণ্য। প্রথম জীবনে কেউ কেউ এসবে অংশগ্রহণ করলেও অধিকাংশেরই নিজ নিজ সংসার জীবনে এসে এসব কর্মের ধারবাহিকতা বজায় থাকেনা, রক্ষিত হয়না নিজস্ব সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতা। তাই জুম্ম নারী সমাজে নারী মুক্তি আন্দোলন-উন্নয়নের খুব একটা ব্যতিক্রম বা অগ্রগতি হয়নি। বাস্তবিক জুম্ম নারীদেরই এই বিষয়ে অজ্ঞতা, উদাসীনতা বা অসচেতনার কারনে এ ব্যাপারে সাফল্য আসছে না। অথচ নারী মুক্তি আন্দোলনে নারীদেরই সাগ্রহে এগিয়ে আসতে হবে, পুরুষের পাশাপাশি নারীকে সমানাধিকারের ভিত্তিতে নয় মানবাধিকারের ভিত্তিতে মানুষ হয়ে কাজ করতে হবে। প্রচলিত উত্তরাধিকার আইনের যুগোপযোগী সংস্কারের পক্ষে জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর অধিকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। নিজের তাগিদে আপন চেতনায় নিজেদেরই মানবিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে হবে, এই দায়ভার নিজেদেরই বহন করতে হবে।

পার্বত্যাঞ্চলে জুম্ম নারী নির্যাতন হিসাবে যৌতুকের জন্য নির্যাাতন বা এসিড নিক্ষেপের ঘটনা নেই বললেই চলে। অথচ নির্মম সত্য যে পার্বত্য চট্রগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে যে লক্ষাধিক সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা ,কখনও কখনও এই সেনা সদস্য বা সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্ম নারীদের লাঞ্চনা, সম্ভ্রমহানি, হত্যা, অপহরনের মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটে , যার দৃষ্টান্ত খুঁজলেই পাওয়া যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে আমাদের জুম্ম সমাজে এত সঙ্কট, এত টানাপোড়েন, আর সব কিছুতে এত নেতিবাচক চিন্তা-দ্বিধাদ্বন্দ্ব যে এধরনের ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে খুব একটা গ্রাহ্যই করা হয়না। ক্ষেত্র বিশেষে যে কোন ঘটনায় নারীকেই দায়ী করা হয়। এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে প্রকৃত ঘটনার প্রেক্ষাপট যাচাই না করেই পাহাড়ী-বাঙালী সামপ্রদায়িক দাঙ্গা-সহিংসতা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে একজন নারীর কাছে তা অত্যন্ত অবমাননাকর। স্বজাতির লোকদের দ্বারা জুম্ম নারী নির্যাতন খুব একটা না ঘটলেও পরিকল্পিতভাবে বিজাতীয় লোকদের দ্বারা নারী নির্যাতন ঘটলে সঙ্গত কারনে প্রশ্ন জাগে এসব কি পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ী জুম্মদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম সহ জুম্ম নারী আন্দোলনকে পদদলিত করার বহিঃপ্রকাশ মাত্র! তাই, জুম্ম নারী-পুরুষের একে অপরের সহযোগিতা ব্যতীত জুম্ম নারী মুক্তি আন্দোলন বা অন্য যে কোন আন্দোলন সম্ভব নয়।



..............................................................................................................................................



মণিপুরী শিল্প-আঙ্গিক


শুভাশিস সিনহা

বাংলাদেশে অনেক জাতিদের ভেতর পাঙন, মৈতৈ মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরাও রাষ্ট্রের নানান নিপীড়নের শিকার। বাঙালি বাদে অপরাপর জাতি কারোরই নেই এই রাষ্ট্রে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির আপন অধিকার। বাঙলা ভাষার জন্য যখন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয় তখন আমরা ভুলেই যাই বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার জন্য সুদেষ্ণা সিংহ শহীদ হয়েছিলেন। মণিপুরীদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, নুপীলান ও ভানুবিল আন্দোলনের কথা আমাদের ইতিহাসে আসে না। বাঙালি বাদে অপরাপর জাতিসত্ত্বাসমূহের প্রতি রাষ্ট্রের নানান বৈষম্য ও আচরন জাতিসত্তার ইতিহাস ও জীবন সংস্কৃতি যেভাবে আড়াল করে রাখে সেইসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী। জরুরী সকল জাতিসত্ত্বাসমূহের নিজস্ব সংস্কৃতির বহুপাক্ষিক মূল্যায়ন। হয়তোবা অনেক প্রশ্ন থেকে গেলেও সেই জায়গা থেকেই মনিপুরী শিল্প আঙ্গিকের এই লেখাটি উপস্থাপন করা হল।

রাসলীলা
রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার এক নৃত্যগীতাভিনয় অনুষ্ঠান হচ্ছে রাসলীলা। রাস শব্দটি রস শব্দের বিবর্তিত রূপ বলে অনুমান করা হয়। মণিপুরীদের প্রথম রাসলীলা বা রাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান হয় মণিপুরে ১৭৬৯ খৃস্টাব্দে রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মমতে মোহবিষ্ট রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কন্যা লাইরোবিকে রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাস অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলেন। মৈথিলী ও ব্রজবুলি ভাষার বিভিন্ন পদের মণিপুরী সঙ্গীতের নিজস্ব গায়কী ও মুদ্রা-পদবিক্ষেপে জটিল এই গীতিনৃত্যধারা মণিপুরীদের সর্বপ্রধান আঙ্গিক। ৪ প্রকারের রাসলীলা হয়ে থাকে। (১) নিত্যরাস, যা সারা বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে মন্ডপে মন্ডপে হয়। (২) কুঞ্জরাস (৩) বসন্তরাস ও (৪) মহারাস, যা কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। রাসের সাধারণ ক্রম হচ্ছে-
১.সূত্রধারী কর্তৃক রাগালাপ
২. বৃন্দাবন বর্ণন
৩. বৈষ্ণব বন্দনা
৪. বৃন্দার কৃষ্ণ আবাহন
৫. কৃষ্ণ অভিসার
৬.রাধা ও সখীদের অভিসার
৭.রাধা ও কৃষ্ণের সাক্ষাৎ ও মান-অভিমান
৮.ভঙ্গীপারেং
৯. রাধার কৃষ্ণ-সমর্পন
১০. যুগলরূপ প্রার্থনা
১১. আরতি ইত্যাদি।
রাসের মন্ডলী বাঁশ ও কাগজ কেটে বিশেষ কারুকাজে তৈরী করা হয়। মন্ডলীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে ওঝা বা রাসের গুরু, সূত্রধারীগণ এবং বাদকগণ। মৃদঙ্গ ও মন্দিরা বাদ্য হিসেবে গোপিনীদের পোষাক ও অলংকারের কতিপয় নাম-(১) মেইখুম্বি (মাথা ঢাকার ওড়না) (২) লৈত্রেং (কোমরে ব্যবহার্য) (৩) খাওল (কোমর থেকে নীচে নামানো হয়) (৪)তানখা (৫) খুদোপ ইত্যাদি।

গোপরাস বা রাখালরাস বা রাখুয়াল
এই রাস পুরুষদের। শ্রীকৃষ্ণ, সখা বলরাম ও অন্যান্য গোপবালকদের গোষ্ঠে গরু চরাতে গিয়ে সম্মুখীন নানা ঘটনার চিত্র এই রাসে রূপায়িত হয়। কৃষ্ণের নানা অলৌকিক ক্ষমতা ও শক্তিমত্তার স্বরূপ ফুটে উঠে এর কাহিনীতে। এই রাসকে মুখ্যত ২ ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমে নন্দগৃহে মা যশোদা ও রোহিনীর কাছ থেকে যথাক্রমে কৃষ্ণ ও বলরামের গোষ্ঠে যাওয়ার আদেশ চেয়ে গান এবং দুঃখভারাক্রান্ত মায়েদের বিদায়গীতি পর্ব। পরবর্তীতে গোচারণে নানা উপাখ্যান ও শেষে গোধূলীলগ্নে গৃহে গমন।
মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যের বৈষ্ণব ভক্তি ভাবাপন্ন নরম কোমল ভাবের বিপরীতে এখানে তান্ডব ধারার নৃত্যই প্রধান। ওঝা বা গুরু বসে মৃদঙ্গ নিয়ে। আর মানকসাপি বা যশোদা ও রোহিনী-রূপী নারীদ্বয় মন্ডলীর এককোনে বসে গান ও অভিনয় কর্ম সম্পন্ন করে। মঞ্চ ১২ টি কলাগাছ দিয়ে বেষ্টিত থাকে।
পোষাক ও অলংকারের নাম : (১) চূড়া ( মাথায় ব্যবহারের) (২) নূপুর (৩) খৌয়ল (৪) লেইত্রেং (৫) টেরে খোংজি ইত্যাদি।

বেণীরাস
বেণীরাস দিনের বেলা অনুষ্ঠিত মেয়েদের ক্বচিৎ অনুষ্ঠিত একধরনের রাস। সাদামাটা পোষাকে এই রাস অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই রাস হয়ে থাকে। এতে রাধিকা ও সখীদের বিভিন্ন আনন্দদায়ক ঘটনা ও কৃষ্ণের রাধিকা সখ্যতার নানা দুষ্টপ্রদ কাহিনী রূপায়িত হয়। অনেকাংশেই কৃষ্ণ থাকে অনুপস্থিত। বর্তমানে এই রাস হয়না বললেই চলে।


লাইহারাওবা
লাই শব্দের অর্থ দেবতা, হারাওবা অর্থ আনন্দদান, এ পূজার উদ্দেশ্য দেবতাকে তুষ্ট করা। মণিপুরীদের সর্বপ্রাচীন এই নৃত্য (উৎসবও) এখনও কদাচিৎ মণিপুরীদের মধ্যে দেখা যায়।
নারী ও পুরুষ সারিতে ভাগ হয়ে শোভাযাত্রার মধ্যদিয়ে নৃত্যের শুরু করে। হস্তমুদ্রা, বাঁশের দন্ডদিয়ে বিশেষ যাদু, বলখেলা ইত্যাদি ক্রীড়ানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই নৃত্যধারা সম্পন্ন হয়। এতে শাস্ত্রীয় নৃত্যের কোনো চিহ্ন নেই, আদিম উল্লাস ও হর্ষ-অঙ্গভঙ্গি এই নৃত্যের বৈশিষ্ঠ্য।

উলুখরাস বা উদুখলরাস
শ্রীমদভাগবতের ১০ম স্কন্ধে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার কাহিনীকে কেন্দ্র করে এই রাস চয়ন করা হয়েছে। বালক কৃষ্ণের পুতনাবদ, কুবের পুত্রদ্বয়ের যমলার্জুন বৃক্ষরূপ থেকে মুক্তি, শ্রীকৃষ্ণের ননীচুরি, উদুখলবন্ধন ইত্যাদি কাহিনী এই রাসে রূপায়িত হয় আকর্ষণীয় ভাবে। মূলতঃ কার্তিক মাসে, তবে অন্য মাস গুলোতেও হয়ে থাকে।
উদুলখলরামে নৃত্য ও গানের সাথে অভিনয়ের আধিক্যই বেশী দেখা যায়। প্রয়োজনে থিয়েট্রিক্যাল সেট ব্যবহারের লোকজ ধারাও এতে বর্তমান। বর্তমানে এ রাসের অনুষ্ঠান খুব কম।

খুবাক ঈশৈ বা খুবাকুশি
খুবাক অর্থ করতালি আর ঈশৈ মানে নৃত্য। করতালি সহকারে নৃত্যগীতের আসরকে খুবাক ঈশৈ বলে। রথযাত্রার দিন থেকে হরিশয়ন তিথি পর্যন্ত এই আসর হয়। গীতগোবিন্দ থেকে গান গাওয়া হয় এই গীতিনৃত্যে। বৃত্তকারে মেয়েরা বিশেষ পদবিক্ষেপের সাথে খুবাকুশি পরিবেশন করে। এর মাধ্যমে পাপ খন্ডন হয় বলে বিশ্বাস।

নুপীপালা
মহিলাদের এক ধরনের নটপালা-কে নুপীপালা বলা হয়। নুপী শব্দের অর্থ মহিলা। এতে রাধা-কৃষ্ণের নানা প্রণয়লীলা ও নৌকা বিলাস লীলাগীত হয়। মৃদঙ্গ ও মন্দিরা বাদ্য হিসেবে বাজানো হয়। এতে একজন ইশালপি বা গায়িকা নেয় রাধা চরিত্র, আরেকজন কৃষ্ণ। তারা মুক্ত বর্ণনাতেও অংশ নেয়।

থাংতা
থাং অর্থ তরবারি, তা অর্থ বল্লম। তরবারি ও বল্লম দিয়ে শারীরিক কৃৎকৌশলের বিশেষ নৃত্যকলাকে থাংতা বলা হয়। মণিপুরে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন খুবই কম।

ধ্রুমেল
নটপালার অন্তর্ভূক্ত। তবে আলাদাভাবেও হয়। মৃদঙ্গ বাদনের প্রতিযোগীতার অনুষ্ঠান। সঙ্গে মন্দিরা ও করতালও বাজানো হয়। জোড় সংখ্যক বাদক হতে হয়। মহাধ্রুমেল, গৌরধ্রুমেল ইত্যাদি নানা প্রকারের ধ্রুমেল রয়েছে।

হোলি
হোলি উৎসব কিংবা দোলপূর্ণিমার উৎসব ফাগুয়াতে মণিপুরীদের যে পরিবেশনা বাদ্য, গীত ও নৃত্য সহযোগে হয়ে থাকে , তারই নাম হোলি। রাধা-কৃষ্ণের ফাগু বা আবীর খেলার বিভিন্ন রসঘন বর্ণনা, বসন্তের প্রকৃতিবর্ণন ও কৃষ্ণ-গৌরাঙ্গ তত্ত্বের নানা ব্যাখ্যা নিয়ে আকর্ষণীয় এ পরিবেশনার জন্য বিভিন্ন ভ্রাম্যমান দল গঠন করা হয়। দলে নারী-পুরুষ উভয় শিল্পীই থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে হোলির দল গান পরিবেশন করে থাকে। তাদের মধ্যে গানের ফাঁকে ফাঁকে ফাগু খেলাও চলে। কজন মূল গায়ক হোলিগানের নেতৃত্ব দেয়, একেকটি পদ পরবর্তীতে সকলে ধুয়া তুলে বা পুনরাবৃত্তি করে। গানের শেষে বাদ্যের তান্ডব খোলা শুরু হয় নির্দিষ্টতালে।
বাদ্য হিসেবে মন্দিরা, করতাল, মৃদঙ্গ ও ঢোল ব্যবহার করা হয়। গায়কেরা ইনাফি বা ওড়না দিয়ে নানা চরিত্রের উপস্থাপনে প্রতীকী আবহ তৈরী করে। হোলির একটি জনপ্রিয় গানের কয় লাইন-

খেলব খেলব শ্যাম তোমার সনে
একেলা পাইয়াছিরে শ্যাম
এ নিঠুর বনে।
রাইর হাতে পিচকারী
আতর গোলাপ ভরি
ছাড়িয়া না দিব ত্বরা
মারব পিচকারী---

লেরিক দেনা বা পুঁথিপাঠ
লেরিক দেনা মণিপুরী সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য শিল্প-আঙ্গিক, যা একই সঙ্গে কৃত্য ও শিল্প। রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্য চরিতামৃত, গীতা ইত্যাদি ধর্মীয় পুস্তকাদি থেকে একজন সুরেলা আবৃত্তি করে নির্বাচিত অংশ, আরেকজন তার সরল গদ্যানুবাদ ও ব্যাখ্যা প্রদান করে। পাঠ বা আবৃত্তির বিশেষ এক ঢঙ আছে, যা পুঁথিপাঠ-এর মত নয়, একেবারেই নিজস্ব। যিনি ব্যাখ্যাকারী, তাকে অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাশীল হতে হয়। আসর বুঝে সরল উদাহরণ সহকারে সে বক্তব্যকে সবার কাছে বোধগম্য করে। শ্রোতা-দর্শকের সাথে সার্বক্ষণিক সমঝোতা ও বোঝাপরার মধ্য দিয়ে লেরিক দেনা এগিয়ে যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় কৃত্যে-পার্বণে এটি একটি আবশ্যিক পরিবেশনা।

পদাবলী কীর্তণ
বিভিন্ন বৈষ্ণব পালাকারের পদ বা কাহিনী নিয়ে পদাবলী কীর্তণ হয়। পদাবলী কীর্তণে একক ও বিচ্ছিন্ন পদের সমাহার নিয়েও গান হয়ে থাকে, আবার পূর্ণাঙ্গ লীলা ভিত্তিক গানও হয়ে থাকে। নৌকা বিলাস নিমাই সন্ন্যাসপালা গোষ্ঠলীলা ইত্যাদি পালার পরিবেশনা দেখা যায় মণিপুরীদের মধ্যে। মৈথিলী ও ব্রজবুলি পদ থেকে মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করে ও সুরের স্বকীয় মিশ্রণে পদাবলী কীর্তণও মণিপুরীদের মধ্যে এক নিজস্বতা লাভ করেছে। বিভিন্ন হাবভাব ও অঙ্গভঙ্গি সহকারে লীলা পরিবেশন করে গানের ফাঁকে প্রলম্বিত সুরেলা বর্ণনা থাকে, আর তার চতর্ুদিকে দোহার ও বাদক দল বসে লীলা পরিবেশনার অলংকার তৈরি করে।


…………………………………………………….……
…………………………………………………….……



সম্পাদকীয়

জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দশক শেষে দশকের দিকে ফিরে তাকানো ও অতীত এবং সমসাময়িক মূল্যায়নের পাশাপাশি আজ সামগ্রিক মূল্যায়নের সময়ও উপস্থিত হয়েছে নিশ্চয়ই। Indigenous people : partnership in action কে সামনে রেখে, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-এ আদিবাসী ইস্যু সম্পর্কিত বিভিন্ন মূলসুর নিয়ে কাজ চলছিল।

একদিকে যখন জাতিসংঘ কর্তৃক আদিবাসীদের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি-জীবনাচার-প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চতকরনের ডাক দেয়া হয় তখন জাতিসংঘেরই আশীর্বাদপুষ্ট অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার হরনের নানা আয়োজনে সহযোগিতা করার বিষয়গুলো সত্যিই ভাবনায় ফেলে দেয়। যখন দেখি আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের বুদ্ধি-পরামর্শ ও অর্থায়নে হাজার হাজার চাকমা, ম্রাইনমা, ত্রিপুরীদের বসতভিটা তলিয়ে দেয়া হয় বাঁধ নির্মাণ করে; রাবার বাগান, উডলট, ন্যাশনাল পার্ক, ইকোপার্কের নামে মান্দি,কোচ, বর্মনদের উচ্ছেদ করা হয় মধুপুরের শালবনকে দখল করার জন্য তখন জাতিসংঘ ঘোষিত বিভিন্ন আদিবাসী দরদি শ্লোগানগুলো হাস্যকরই ঠেকে। কল্পনা চাকমা অপহরন; আলফ্রেড সরেন-গীতিদা রেমা-পীরেন স্নালের রক্তের দাগতো লেগে রয়েছে আদিবাসী দশকেই! এ সময়েই মৌলভীবাজার সিলেটের পুঞ্জিগুলোতে মান্দি-খাসিয়াদের নিরাপত্তাহীনতার অভাবে জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়, ফরেষ্ট গার্ডের গুলিতে নিহত হতে হয় অবিনাশ মুড়া কে।

ভূমির অধিকার চিরন্তন অধিকার। কোন মানুষ যদি ভূমিই হারিয়ে ফেলে তবে তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ সম্পর্কিত জ্ঞানও হারিয়ে যাওয়া অমূলক নয়।

মৃত্তিকা প্রকাশ হলো এমন একটি সময়ে যখন আদিবাসী দশক শেষ বলে ঘোষিত হবে। তাই এই মুহর্ুতে দশক ভাবনাকে পূনঃমূল্যায়নের সুযোগ এসেছে। আমরা সাধ্যমত জাতিসত্ত্বার উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো সামনে আনার চেষ্টা করেছি। মৃত্তিকা পৃথিবীর সকল জাতির লোকায়ত জ্ঞান এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল; জাতিতাত্ত্বিক লোকায়ত জ্ঞান এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক গভীর ভাবে জানতে, বুঝতে ভীষণ আগ্রহী।

পৃথিবীর সকল জাতিসত্ত্বা সমূহের আপন অধিকার ,আপন মহিমা ও গৌরবে অগ্রসর হওয়ার পক্ষ নিয়েই মৃত্তিকা আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চায়।