Friday, September 14, 2007

মৃত্তিকা; বর্ষ ক্রম:০২, সংখ্যা ক্রম: ০২




মৃত্তিকা
জাতিতাত্ত্বিক লোকায়ত জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ
বর্ষ ক্রম:০২, সংখ্যা ক্রম: ০২
প্রকাশকাল: বৈশাখ ১৪১২ বঙ্গাব্দ, মে ২০০৫ খৃ.
সম্পাদনা: জুয়েল বিন জহির,পরাগ রিছিল, দুপুর মিত্র; সহযোদ্ধা : জাহানারা খাতুন সীমা, তাসলিমা আক্তার রোমন, শারমীন শর্মী
নামচিত্র ও প্রচ্ছদ : পাভেল পার্থ
অক্ষর বিন্যাস : শোভন লাল সাহা, জুয়েল বিন জহির
বর্ষা প্রাইভেট লিমিটেড, ৮/৩ বাবুপুরা, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫ থেকে মুদ্রিত এবং ৩৪৭ শহীদ সালাম বরকত হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত।
বিনিময়: ২০টাকা মাত্র।



সম্পাদকীয়

সারা দুনিয়ার জ্ঞান কাঠামো এখন খুব স্পষ্ট হয়েই দ্বিধাবিভক্ত। নিপীড়ক জ্ঞান কাঠামো আর নিপীড়িত জ্ঞান কাঠামো। পুঁজিভিত্তিক ব্যবস্থার টালবাহানায় একদিকে বেড়ে উঠছে নিপীড়ক জ্ঞান কাঠামো, অন্যদিকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে নিপীড়িত জ্ঞান কাঠামো। প্রাতিষ্ঠানিক এই নিপীড়ক জ্ঞান কাঠামোর ভিতর দিয়েই নির্মিত হচ্ছে আমাদের মেধা-মনন-সত্তা। সতি্যকার অর্থে আমরা বাধ্য হচ্ছি। তাই সহজেই বলে ফেলছি- লোক জ্ঞান! লোক ধর্ম! অসভ্য জাতি! অস্পৃশ্য সমাজ! প্রভৃতি। নিপীড়ক জ্ঞান কাঠামোকে কখনোই বুঝার চেষ্টা করছি না। প্রশ্ন তুলছি না নিপীড়ক জ্ঞান কাঠামোকে নিয়ে।

আমাদের এই সংখ্যায় সবগুলো লেখা ক্ষুদ্রজাতিসত্তার নিপীড়িত জ্ঞানেরই সরব উপস্থিতি। শুভাশিস সিনহার লেখায় এসেছে ভানুবিলের আড়াল হয়ে যাওয়া কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের কথা- এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই আসাম সরকার১৯৩৫ সালে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইল পাশ করে। যে জমি জমার উপর কৃষকদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জমির খাজনাও কেদার প্রতি আড়াই টাকার পরিবর্তে দুইটাকা সাব্যস্ত করা হয়। তৈরি হলো নতুন শাসনতন্ত্র। সংগঠিত মানুষের বিজয় সূচিত হয়েছিল ভানুবিলে। আর মুখ তুলে বলেছে ইতিহাস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদর্পে রুখে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই । মানখিন প্রদীপ সাংমা তুলে ধরেছেন আচিক ভাষার বর্ণমালার প্রসঙ্গ- কিন্তু ভাষাকে লিখিত রূপ দেবার যে স্বপ্ন মান্দি জাতির বুকে দীর্ঘদিন ধরে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা থেমে নেই। আর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর চিন্তাভাবনার ফলস্বরূপ মোট ২৬ টি বর্ণের আচিক বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছি। উদ্ভাবনকৃত বর্ণমালার নাম দিয়েছি-আচিক থোকবিরিম । পাভেল পার্থের লেখায় ভেসে উঠেছে নিপীড়ক সামাজিক জ্ঞান কাঠামোর বেহায়াপনা- আগত অতিথিদের প্রতিজনকেই আলাদা থালায় মিষ্টি দিলেও ডুকলাদের দলটিকে একটা বড় তাগাড়ে মুড়ি আর গোটাকয় মিষ্টি দেয়া হয়েছে;কেবলমাত্র ডুকলাদেরকেই প্লেট ছাড়া চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আসলে এটা বিয়ে বাড়ির ব্যবস্থাপনার কোন ত্রুটি বা আর্থিক টানাপোড়েনের বিষয় ছিল না। বা এমন নয় যে প্লেট সংকট হয়েছে। এ হচ্ছে নিয়ম । দুপুর মিত্র তুলে ধরেছেন হারিয়ে যাওয়া মান্দি, কোচ ও হাজং সমাজের অসুখ-বিসুখের দেব-দেবীদের- কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, এই সব দেব-দেবীর নাম ও আচারাদি সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি অনেক আচার অনুষ্ঠানই হারিয়ে যেতে বসেছে। নানান জনের সাথে আলাপ করতে গিয়ে মনে হয়ছে এগুলো হারানোর পিছনে যতটা না অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দায়ি, তারচেয়েবেশি নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে নিজেরাই খাটো করে দেখা । মৃত্তিকা চাকমা দেখিয়েছেন নিপীড়িত চাকমা সমাজে একটি থিয়েটার কীভাবে যুদ্ধ করেছিল- রাঙ্গামাটির গুটিকয়েক তথাকথিত আদিবাসী জ্ঞানীজন-গুণীজন জাক এর কর্মীদের উপর সমালোচনায় উন্মুখ। তাঁদের ধারণা নাটক মানে শুধু বাংলা ভাষায়, কী মঞ্চে কী লেখ্য রূপে! পরাগ রিছিল তুলে ধরেছেন মহাকাব্যের বিস্তৃতি নিয়ে আচিক সাহিত্যে রয়েছে যে খাত্তাদক্কা- স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় প্রবল সাংস্কৃতিক চাপের মুখে নীচে পড়ে যাওয়া বা আড়ালে সরিয়ে রাখা এসব সাহিত্যকর্ম। সে যা হোক অসাধারণ কিংবা খুব সাধারণ-ই। কোথাও এগুলোর আলোচনা, বাঁচিয়ে রাখার মতো নূন্যতম চেষ্টা নেই!

প্রতিটি লেখার উপস্থিতি জেগে ওঠবার প্রেরণা যোগাবে নিশ্চিত।

জয় হোক নিপীড়িত জ্ঞান কাঠামোর



সূচীপত্র


প্রবন্ধ : ভানুবিলের কৃষক আন্দোলন : একটি পর্যালোচনা
শুভাশিস সিনহা

আচিক থোকবিরিম
মানখিন প্রদীপ সাংমা

ডুকলাদের সকল ঢোল বেজে ওঠুক বর্ণদাপটের বিরুদ্ধে
পাভেল পার্থ

অসুখ-বিসুখের দেব-দেবী : মান্দি, কোচ ও হাজং সমাজের দলবদ্ধ হওয়ার প্রতীক
দুপুর মিত্র

চাকমা নাটক ও জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল
মৃত্তিকা চাকমা

খাত্তাদক্কা
পরাগ রিছিল















ভানুবিলের কৃষক আন্দোলন : একটি পর্যালোচনা
শুভাশিস সিনহা

১৮৫৩ সালে লিখিত ভারতে বৃটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল শীর্ষক প্রবন্ধে কার্ল মার্কস ভারতে ইংরেজ প্রভুত্বের ধরন-ধারণ, নতুনত্ব, করণীয় বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন, সর্বহারার বিপ্লব ও বিজয়পন্থার ঐতিহাসিক সূত্রানুযায়ী সংস্কার থেকে উৎপাটনের স্তরন্যাস সূচিত করতে গিয়ে তিনি ভারতবর্ষে আগন্তুক ইংল্যাণ্ডের জন্য দ্বিবিধ কর্তব্যের কথা উল্লেখ করেছেন, একটি ধ্বংসমূলক এবং অন্যটি উজ্জীবনমূলক-পুরাতন এশীয় সমাজের ধ্বংস এবং এশীয়ায় পাশ্চাত্য সমাজের বৈষয়িক ভিত্তির প্রতিষ্ঠা।

উপনিবেশের দীর্ঘ সময়ে পূর্ববর্তী অন্যান্য শাসকবর্গের চেয়ে অনেক জোরালোভাবে বৃটিশরা এ-কাজটাই করতে চেয়েছে এবং নিজেদের মরণগর্তও খুঁড়েছে একইসঙ্গে। ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উৎপাদনের বহুল বিন্যস্ত সম্পর্কের রূপ পাঠে অনভিজ্ঞ ইংরেজরা একরৈখিক চিন্তায় সামনে টেনেছে গোটা ভারতকে। শোষণের অদম্য স্পৃহায় ১৭৯৩ সালে তারা প্রবর্তন করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে জমিদার, মধ্যস্বত্বভোগী ও রায়ত - তিন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। ভূমি ও উৎপাদনের সাথে সম্পর্কবিহীন মধ্যস্বত্বভোগী পরগাছা শ্রেণী ও জমিদারের দ্বৈত শোষণ ইংরেজ শাসনের নিরাপত্তা বৃদ্ধির সহায়ক হলেও প্রজা-নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা সামন্ত জমিদারদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে দেয়।

জমি বা ভূমিকে কেন্দ্র করে কৃষকসমাজের কেবল জীবনীচিন্তাই নয়, বিকশিত তার দার্শনিক সত্ত্বাও। বাংলার লোকায়ত জীবনে সেই শক্তির যৌগ বিধ্বংসী রূপে আভাসিত হয়নি ইংল্যাণ্ডের শিল্পপ্রবণ বেনিয়াদের সামনে। ফলে আঘাত এসেছে অবিশ্বাস্য গতিতে, বৈচিত্র্যে।

বিশ শতকের বিশের দশকের অন্তিমে বৃহত্তর সিলেটের অন্তর্গত মৌলভীবাজার জেলাধীন কমলগঞ্জ থানার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল পরগনায় সংঘটিত কৃষকবিদ্রোহ বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির সামনে ছিল এমনই এক আঘাত।

বিদ্রোহী কৃষকরা জাতিগতভাবে ছিল মণিপুরী, মেইতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া ও পাঙন সমপ্রদায়ে অন্তর্বিভক্ত। তাদের পূর্বভূমি ছিল ভারতের মণিপুর রাজ্য, সেটাই তাদের ওরিজিন বা উৎস। পার্শ্ববর্তী বর্মী সৈন্যদের সাথে বারবার সংঘর্ষ, শাসক রাজাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক রূপান্তরকরনের হুকুমদারি, নাগা বিদ্রোহ, প্রভৃতি রাজনৈতিক সংঘাতে পর্যুদস্ত মণিপুরীদের একাংশ মণিপুর থেকে পালিয়ে (বা বিতাড়িত হয়ে) ভারতের আসাম, ত্রিপুরায় এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলায় এসে বসতি স্থাপন করে। উত্তরগাঁও, মাঝেরগাঁও, স্থনগাঁও, কোনাগাঁও, তেতইগাঁও-এই পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ভানুবিল মৌজায় সর্ববৃহৎ অভিবাসন ঘটে মণিপুরীদের। এ মৌজায় বসতি স্থাপন করে ৭৫২ টি পরিবার। জমিদার ও উপনিবেশবিরোধী কৃষকবিদ্রোহে এসকল পরিবারের প্রায় সকল নারীপুরুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল।

প্রাণের মায়ায় জন্মভূমি ত্যাগ করে এসে অতিকষ্টে পাহাড় জঙ্গল আবাদ করে বসতি গড়ে তোলা অভিবাসী মণিপুরী জনগণ ধীরে ধীরে চিনে নিতে থাকে শত্রুর নতুন মুখ। উপনিবেশিক শাসক বৃটিশদেরকে সরাসরি নয়, তারা পেয়েছিল বৃটিশেরই পোষ্য প্রতিফলিত জমিদার শ্রেণীর অন্যতম প্রতিভূ আলী আমজাদ খাঁকে; অত্যাচারী, নির্মম শোষক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ভক্তিপ্রবণ, স্বাধীনচেতা, বিনম্র মণিপুরী জনগণের সামনে। মণিপুরী জনগণই মণিপুরী কৃষকসমাজ, সেসময় কৃষি ছাড়া মণিপুরীদের আর কোনো জীবিকাই ছিল না। আলী আমজাদ খাঁ ছিলেন তৎকালীন লংলার পৃথিমপাশার জমিদার। আর তার সুযোগ্য নায়েব ছিলেন রাসবিহারী দাশ। জুলুমবাজ রাসবিহারীকে নিয়ে আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন তাঁর পুঁথিকাব্যে বলেছেন, পেট মোটা রাসবিহারী চলিতে না পারে দশ বার জনে উঠাইয়া দিলা হাতীরও উপরে' । রাসবিহারী রশিদ না কেটেই প্রজাদের খাজনা আদায় করতেন। ফলে একদিন প্রজারা অবাক দেখতে পায় হিসাবের খাতায় তাদের খাজনা পরিশোধের কোনো চিহ্ন, দলিল নেই। শত শত কৃষকের উপর নোটিশ জারি করা হলো। জমিদার ও নায়েবের অত্যাচার, তার উপর পরিশোধিত খাজনা পুনর্বার পরিশোধের প্রহসন-নোটিশ, সব প্রজাদেরকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। অনিবার্য হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ আর একদাদুর মণিপুরের নতজানু মণিপুরীরা সুস্পষ্ট প্রতিপক্ষ ও অন্যায়কারীকে চিনে এবং শোষণের নির্ভেজাল রূপকে বুঝে নিয়ে এবার হয়ে ওঠে ঊর্ধ্বশির, মুষ্ঠিবদ্ধ, বিশাল সমবেত গর্জনে দীপ্রমান। ( মার্কস কি ইংরেজদের দ্বিবিধ কর্তব্যের অনুকুলপ্রতিম দিকনির্দেশ দিয়ে আদতে এমন পরিণতিই টেনে আনতে চেয়েছিলেন? )

তখন ১৯৩০ সাল। গোটা বিশ্বেই পুঁজিবাদের অন্তক্ষয়ী বিরোধ সংঘর্ষ, সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত রূপ প্রকটিত, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের অভ্যূদয়, আশা-হতাশার দোলাচলে বিশ্বের শোষিত শ্রেণীর বিপ্লবচিন্তা কমপ্রমান, উপমহাদেশের উপর অতিকায় বৃটিশ উপনিবেশের বোঝা, রাজনৈতিক প্রকল্প-কর্মমূচী তৎপরতা একাকার হয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। তাই ভানুবিলের পঞ্চানন শর্মা, বৈকুণ্ঠনাথ শর্মা, কাসেম আলী (মুসলিম মণিপুরী/পাঙন), নবদ্বীপ সিংহ, গিরীন্দ্রমোহন সিংহ প্রমূখ মণিপুরী কৃষক নেতাদের সঙ্গে আন্দোলনে মতাদর্শে ও প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেন তৎকালীন কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের অনেক নেতা। দ্বারিকা গোস্বামী, নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী, পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত, চারুবালা দেবী প্রমূখ নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রান্তিক ভানুবিলের বিদ্রোহ পেয়ে যায় মূলধারার রাজনৈতিক সংগ্রামের মর্যাদা ও তাৎপর্য।

ভানুবিলের কৃষক আন্দোলনে মণিপুরী নারীদের ছিল ব্যাপক অংশগ্রহণ, এমনকি নেতৃত্বেও শরিক হয়েছিল অনেক নারী। লীলাবতী শর্মা, সাবিত্রী সিংহ, শশী প্রভা দে, যোবেদা খাতুন এমন অসংখ্য বিদ্রোহিনীর সদর্প পদক্ষেপে ভাঙানোন্মুখ কেঁপেছে অত্যাচারের দূর্গ। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, কৃষিকাজে পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবেই অংশ নেয়া মণিপুরী নারীরা তো গর্জে উঠবেই।

দমনপীড়ন নীতিই যথারীতি গ্রহণ করলেন আলী আমজাদ খাঁ, অসংখ্য নেতা কর্মীকে কয়েদখানায় আটকে রাখলেন । পুঁথিকাব্যে পাওয়া যায়;-

সাহেব বলেন, প্রজাগণ বলি তোমাদের কাছে
ভানুবিলের বহু খাজনা বাকি পড়িয়াছে।
অজ্জে অজ্জে বাকি খাজনা পরিশোধ করিয়া
নতুন কবুলিয়াত দিবায় লেখিয়া।
তারা কহে মিয়া সাহেব এমন কইবায় না
প্রাণ থাকিতে কবুলিয়ত আমরা দিব না।
যে সময়ে মণিপুরীগণ এ কথা কহিলা
বারুদের ঘরে যেন আগুন লাগাইলা।
হুকুম করিয়া সাহেব দেশওয়ালী ডাকিয়া
পিলখানাতে মণিপুরী সব রাখ বান্দিয়া...


একটি মণিপুরী গীতিকবিতাতে তার পরবর্তী বিদ্রোহ সংগ্রামের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। অনুবাদে সেটি পড়া যাক,
ঘরে থেকে পঞ্চানন সব কথা শুনলো
কাসিম সর্দার তার ঘরেতে দাঁড়ালো।
পঞ্চানন তার সাথে পরামর্শ করে
দুই হাতে বাঁশ আর দাও নিলো ধরে...


সেই যুদ্ধে পঞ্চানন শর্মা শত্রুপক্ষের আগুয়ান হাতী-ঘোড়া সৈন্য নিজ হাতে ক্ষত- বিক্ষত করেছিল, রাসবিহারী দাশও ক্ষুব্ধ মণিপুরী জনগণের হাতে ভূপাতিত হন।

গোটা ভারতবর্ষে তখন চলছিল জাতীয় পর্যায়ে নানামুখী বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, গান্ধীর নেতৃত্ব সত্যাগ্রহ আন্দোলন নিয়েছিল তীব্ররূপ।

ভানুবিল কৃষকবিদ্রোহের অব্যবহিত আগে মিলে চুর যাই ও কুলাউড়ায় ঘটে যাওয়া আন্দোলনগুলোও তখন কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। এছাড়াও বৃহত্তর সিলেটের শোষিত নিম্নবর্গের অসংখ্য বিদ্রোহের ইতিহাস ভানুবিলের কৃষক প্রজাদের সংগ্রামে, পরিকল্পনায়, নেতৃপর্যায়ের চিন্তা তৎপরতায় রেখেছিল বৌদ্ধিক - প্রায়োগিক ভূমিকা। যেমন - পাণ্ডুয়ার খাসিয়া বিদ্রোহ, হবিগঞ্জের কৃষক আন্দোলন, চা শ্রমিক বিদ্রোহ, লবণ-সত্যাগ্রহ আন্দোলন, বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলন, চৌকিদারী কর-বিরোধী সংগ্রাম ইত্যাদি।

শোষণ-নিপীড়নের অদূর অতীতকালের অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকার, সুস্পষ্ট অবিচার, রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রভৃতি শর্ত মিলে ভানুবিলের কৃষক সংগ্রাম ধারণ করে শোষিত-নির্যাতিতের জাতীয়তা সূচক এক মহাবিপ্লবের রূপ, যা উপনিবেশ থেকে মুক্তির মহাভারতীয় সংগ্রামের সাথে কোনো না কোনভাবে এক হয়ে যায়, যার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় কৃষকসমাজ বা নিপীড়িতের মুক্তি। আন্দোলনের কালে নির্মমভাবে নির্যাতিত, অত্যাচারিত কৃষকেরা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। গণ গ্রেফতারের পরোয়ানা ও আন্দোলন দমনে বাধা হতে পারেনি। টানা প্রায় ৩ বছর সেই আন্দোলন চলে।

এরই মধ্যে অবশ্য ঘটেছিল শাসককুলের পরিবর্তন। জমিদার আলী আমজাদ খাঁ-র মৃত্যু ঘটলে তার পুত্র আলী হায়দার খাঁ প্রজা শাসনের ভার নেন। রাসবিহারীর স্থলে নায়েব হন প্রমোদ ধর। কিন্তু স্বভাবচরিত্রে তারা একই রকম। প্রমোদ ধর ছিলেন আরও নিষ্ঠুর ঘাতক। জমির খাজনাও বাড়িয়ে দেয়া হয়, কিয়ার প্রতি দেড় টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই টাকা। গাছ কাটা, পুকুর খনন করার অধিকারটুকুও হরণ করে নেয়া হলো। ফলে বিক্ষোভ অবাধ্য হয়ে উঠেছিল ক্রমশ:।

আনুমানিক (বিভিন্ন নথিপত্র অনুযায়ী) ১৯৩২ সালের দিকে এ-আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে কৃষক প্রজাদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। তাদের খেসারত দিতে হয়েছে অনেক - প্রায় ৩০০টি ঘর হাতী দিয়ে মাড়িয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে, ক্রোক করা হয়েছে সবকিছু। এক সময় গরু-বাছুর ক্রোক করতে এলে কৃষকেরা সেগুলোকে গোয়ালঘর থেকে দূর মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসত নিয়ম করে সাময়িক রেহাই পাবার জন্য।

আবার আন্দোলন অহিংস নীতিতে চলার জন্য শর্তায়িত বলে অদ্ভূত কৌশলও নেয়া হত যেমন - জমিদারের হাতী-ঘোড়া, ঘর-বাড়ী মাড়াবার জন্য এলে পাড়ার লোকজন এসময়ে ঢাক-করতাল, শেলপুৎ, মইবঙ (শঙ্খ) বাজিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিত। এভাবে অভিবাসিত ভক্তিভাবাপন্ন বৈষ্ণব ধর্মাশ্রয়ী মণিপুরী জনগণ নানা কৌশলে, সাহসে, স্পৃহায় সংঘটিত করেছে একটি মহান সংগ্রাম। যার প্রতিপক্ষ শুধু জমিদার বা সামন্তশ্রেণী নয়, আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সৈন্যরাও যেখানে শত্রুপক্ষকে স্পষ্ট সহযোগিতা করে। তবে বৃটেনের লেবার পার্টি তার সমালোচনা করে। বিদ্রোহের ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করতে সে দলের ৩ জন পার্লামেন্ট সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কমিশন ভানুবিলে আসেন। তাঁরা হলেন, - মিস উইল কিনসন, থ্রী.ভি.কে কৃষ্ণমেনন প্রমূখ। বৃটিশ পার্লামেন্টেও ভানুবিলের ঘটনা আলোচিত হয়। এর পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে। একটি স্থানিক বিদ্রোহ গোটা ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সহায়ক হয়ে ওঠে।

ভানুবিলের কৃষক আন্দোলন তাৎপর্যপূর্ণ, ঐতিহাসিক, এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই আসাম সরকার ১৯৩৫ সালে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করে। যে জমি-জমার উপর কৃষকদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জমির খাজনাও কেদার প্রতি আড়াই টাকার পরিবর্তে দুই টাকা সাব্যস্ত করা হয়। তৈরী হলো নতুন শাসনতন্ত্র। সংগঠিত মানুষের বিজয় সূচিত হয়েছিল ভানুবিলে। আবার মুখ তুলে বলেছে ইতিহাস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদর্পে রুখে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতি অনভিজ্ঞ সহজ-সরল মণিপুরী জনগণ সেটা বুঝে নিয়েছিল।

আর সেই শিক্ষা তাদের জীবন-সংস্কৃতিতে-রাজনৈতিক অস্তিত্বকেও জাগিয়ে তুলেছিল। তুলেছিল বলেই পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মণিপুরী জনগণ অনেককিছু চিন্তা না করে শুধু শোষণ ও অন্যায়কে নিজেদের মতো চিনে নিয়ে শোষিত বাঙালির পক্ষে লড়াই করেছে অস্ত্র হাতে, জীবনপণ করে। সে-ও এক ইতিহাস।








আচিক থোকবিরিম
মানখিন প্রদীপ সাংমা

মানুষের কন্ঠ থেকে যে ধ্বনি নির্গত হয় তা দেখা যায় না। এই ধ্বনিকে লেখে প্রকাশ করার জন্য দরকার সাংকেতিক চিহ্নের বা বর্ণের। প্রাণী জগতের মধ্যে কেবলমাত্র মানুষই শব্দ বা ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে যে মনের ভাব ব্যক্ত করে, সেই ভাব স্থায়ীরূপে ধরে রাখার জন্য যুগে যুগে উদ্ভাবন করেছে বিভিন্ন ধরনের লিখন পদ্ধতির বা বর্ণমালার। গঠনগত ও সংখ্যাগত ভাবে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা সমূহের মধ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা রয়েছে। আর এই বৈচিত্র্যতার মাধ্যমে একেক ভাষা-ভাষী জাতিগোষ্ঠীর নিজ নিজ স্বকীয়কা আরো বেশী সুষ্পষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয়; যেমনঃ সংখ্যার দিক থেকে সংস্কৃত ও বাংলা বর্ণমালা ৫১টি, হিব্রু ২২টি, গ্রীক ২৪টি, লাতিন ২২টি, স্পেনীশ ২৭টি, চাইনিজ প্রায় ৮০,০০০টি এবং গঠনগত দিক থেকেও এদের বৈচিত্র্যতা বেশ সুস্পষ্ট। সাংকেতিক চিহ্ন বা বর্ণমালার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা তাদের যুগসঞ্চিত আপন জ্ঞান, বিশ্বাস, ভাল-মন্দ ও উত্থান-পতনের ইতিহাস পৌঁছে দিচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রায় ১৫ লক্ষেরও অধিক লোক মান্দি জাতিসত্ত্বার। টিবেটো-চীন ভাষা পরিবারের বোডো শাখাভুক্ত আচিক ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালার প্রচলন আজও করা সম্ভব হয়নি। তবে সুপ্রাচীন কালে মান্দিদের নিজস্ব বর্ণমালা ছিলো বলে জনশ্রুতি রয়েছে মান্দি সমাজে। বিভিন্ন কারণে তা হারিয়ে গেছে। আচিক ভাষাকে লিখে প্রকাশ করার জন্য অনেককেই রোমান বা বাংলা হরফ ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু আচিক ভাষা তার আপন বর্ণমালায় যতটা সুন্দর ও সাবলীলভাবে পরিষ্ফুট হবে তা কখনোই অন্য কোন হরফের মাধ্যমে সম্ভব হবে না। এই চেতনাবোধ থেকেই নিজ জাতির নিজ ভাষাকে নিজ বর্ণমালায় প্রকাশ করার জন্য এর আগে জন থুসিন রিছিল, ডানিয়েল আর রুরাম ও মার্টিন রেমা নামক বাংলাদেশের তিনজন মান্দি গবেষক আলাদা আলাদা গবেষণার মাধ্যমে তিন ধরনের আচিক বর্ণমালার উদ্ভাবণ করেছিলেন। কিন্তু নানান কারণে উদ্ভাবিত আচিক বর্ণমালা সমূহের কোনটিরই স্বার্থক প্রচলন ঘটানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু আচিক ভাষাকে লিখিত রূপ দেবার যে স্বপ্ন মান্দি জাতির বুকে দীর্ঘদিন ধরে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা থেমে নেই। আর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর চিন্তা-ভাবনার ফলস্বরূপ মোট ২৬ টি বর্ণের আচিক বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছি। উদ্ভাবনকৃত বর্ণমালার নাম দিয়েছি আচিক থোকবিরিম । এই আচিক থোকবিরিম দিয়েই আচিক ভাষাকে তার আপন ছন্দে আপন আবহে প্রকাশ করা বেশ সহজ সাধ্য হবে। নিম্নে আমার উদ্ভাবিত আচিক বর্ণমালা সমগ্র মান্দি জাতির সামনে হাজির করছি।

আচিকে এক একটি অক্ষরকে টাপসুয়া (Tapsua) বলে। আর টাপসুয়া অক্ষর সমষ্টিকে থোকবিরিম (Thokbirim) বলা হয়। আচিকে মোট অক্ষর ২৬ টি। এদের মধ্যে এই ৬ টি বর্ণ স্বরবর্ণ বা গামবিরিম (Gambirim) বাকি ২০ টি অক্ষর সামবিরিম (Sambirim) বা ব্যঞ্জন বর্ণ। বাংলায় যেমন স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণ কে একত্রে বর্ণমালা বলা হয় তেমনি আচিকেও সামবিরিম এবং গামবিরিম অক্ষর সমষ্টিকে থোকবিরিম বলা হয়।

বি.দ্র.- কিছু কারিগড়ি সমস্যা থাকায় এই লেখাটির পুরোটা দেয়া সম্ভব হলো না বলে আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করছি। অতি শীঘ্রই তা দিয়ে দিতে পারব বলে আশা রাখি।



ডুকলাদের সকল ঢোল বেজে ওঠুক বর্ণদাপটের বিরুদ্ধে
পাভেল পার্থ




১.আমাদের হাতে ভদ্রলোকেরা জল খান না...




মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের মাষ্টারপাড়া। বাঙালি হিন্দুর বউপক্ষের বিয়ে বাড়ি। অধিবাস হয়েছে কাল, বিয়ে অবধি ডুকলাদের দলটি আছে। সমানে ঢোলসহ বাদ্য-বাজনা বাজিয়েই চলেছে সবাই। কী কসরৎ! কী বাজনা! কী সুর! কী দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা আর শ্রমের সম্মিলন। নিমন্ত্রিতদের জন্য চা-মিষ্টির পালা এসেছে। আগত অতিথিদের প্রতিজনকেই আলাদা থালায় মিষ্টি দিলেও, ডুকলাদের দলটিকে একটা বড় তাগাড়ে মুড়ি আর গোটাকয় মিষ্টি দেয়া হয়েছে; কেবলমাত্র ডুকলাদেরকেই প্লে­ট ছাড়া চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আসলে এটি বিয়ে বাড়ির কোন ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বা আর্থিক টানাপোড়েনের বিষয় ছিল না। বা এমন নয় যে প্লেট সংকট হয়েছে। এ হচ্ছে নিয়ম। সিলেট জনপদের নিয়ম। এখানে বাঙালি বর্ণহিন্দুরা ডুকলাদের হাতে জল খায় না, নিজেদের বিছানায় ডুকলাদের বসতে দেয় না, ডুকলারা বাঙালিদের লগে বড়জোড় প্লে­ট ছাড়া খালি কাপে চা খেতে পারে।

২.
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ভানুগাছ বাজার। মিষ্টির দোকানে পয়সাপাত্তি থাকলে তো কত জনই আসে ( যদিও এই লিঙ্গীয় দাপুটে সমাজে বাঙালি পুরুষেরাই এই কৌশলটি নেয়)। সুধারাম কর (৩৫) আর কাশীনাথ কর (৩০) দুইজনেই ঢুকে গিয়েছিলেন দোকানের ভেতর। পয়সা দিয়েই দোকানে বসে মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন। দোকান মালিকসহ আর সব ক্রেতারাও জাপটে ধরে তাদের। গালি-গালাজ করে দোকান থেকে বের করে দেয়। সুধারাম আর কাশীনাথ কম পয়সা দিয়ে বা বাকিতে কিনে খেতে চাননি, তারা কেবল দোকানে অন্যদের লগে বসে খেতে চেয়েছিলেন। দোকান মালিক বা ক্রেতাদের লগে তাদের পূর্বতন কোন ঝগড়াঝাটিও ছিল না। আসলে এটি নিয়ম! এইসব অঞ্চলে ডুকলারা নিদারুণ ভাবে অচ্ছুত (!) অস্পৃশ্য (!) । দোকানে বসে অন্যদের লগে কোনো কিছু খাওয়া বারণ। এমনকি কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবেও তাদের খাবারের জায়গা আলাদা। ডুকলাদের লগে এক ঘরে ঘুমালে, একলগে বাজালে, একলগে খেলে, ডুকলাদের হাতের রান্না বা জল খেলে বাঙালি বর্ণহিন্দুর যাবতীয় জাত নাকি চলে যায়।


মানুষের লগে মানুষের এইরকমের ভয়াবহ বিনাশী বর্ণসম্পর্কগুলো এখনও সিলেট জনপদে বহাল আছে। ডুকলাদের ( সিলেট জনপদে এদের নানান নাম, ডুগলা-ঢুলি-কুলি-শব্দকর...!) লগে তথাকথিত বর্ণহিন্দু (!) সহ বাঙালি জাতটাই একটা দাপুটে ফারাক রেখে চলে। ডুকলাদের দিয়ে দাসগিরি করানো হয়, ধকল টানানো হয়, কিন্তু ব্যাটাগিরির বর্ণদাপট এখনও বহাল তবিয়তেই বিরাজমান। তবে দুম করে সিলেট জনপদের বর্ণহিন্দুদের (!) ভেতর এই বর্ণদাপট চলে আসেনি। এইসব বর্ণবৈষম্যের দুনিয়াময় নিপীড়ন আর প্রতিরোধের লড়াই ইতিহাস আছে, আছে নানান রাজনীতিক ইশারা, বহুজাতিক দেন দরবার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান পুস্তকে ‌ডুকলা শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে অসভ্য,নিকৃষ্ট জাতি বা সমপ্রদায়। শব্দটি নাকি হিন্দি দোগলা শব্দ থেকে এসেছে।

শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পুস্তকে ডুকলাদের উদ্ভব ও পরিসংখ্যান সম্পর্কে বলা হয়েছে, “ঢোলি বা বাদ্যকর-ডোম, পাটনি বা কৈবর্ত হইতে ইহাদের উদ্ভব বলিয়া অনুমিত হয়। ইহাদের সংখ্যা ১০২৫৫ জন; (তন্মধ্যে পুরুষ ৪৯৮১ এবং স্ত্রী ৫২৭৪ জন)। যাহারা বাদ্যকর বলিয়া পরিচয় দিয়াছে তাহাদের সংখ্যা ১৫২ জন পূর্বোক্ত সংখ্যার মধ্যে ধৃত হইয়াছে।” সূর্যকুমার তর্কসরস্বতী তাঁর জাতি পুরাবৃত্ত ( ১৯২০ ) পুস্তকে উলে­খ করেছেন-

কুন্ডকারো ডোখলে বা মৃতপঃ হস্তিপস্তথা।
এতে বৈ তীবরাজাতাঃ কন্যায়াং ব্রাহ্মণ্যস্য ॥
তীবরের ঔরসে ব্রাহ্মণীকন্যার গর্ভে উৎপন্ন সন্তান দেশভেদে কুম্ভকারা, ডোখল, মৃতপ ও হস্তিপ নামে প্রসিদ্ধ। ডোখলগন মাতৃজাত্যুক্ত দশরাত্রাশৌচী, ইহারা বাদ্য ব্যবসায়ী।

১৯০৫ সালে বি.সি. অ্যালেন সম্পাদিত আসাম জেলা গেজেটিয়ার্স-এর সিলেট খন্ডে ডুকলাদের ( যদিও ঢুলী বা শব্দকর হিসেবেই পরিচয় করানো হচ্ছে) জনসংখ্যার হিসেব দেয়া হয়েছিল ১০১০৩ জন। ডুকলারা চলতি সময়ে সিলেট জনপদের মৌলভীবাজার জেলাতেই সবচেয়ে বেশী বাস করছেন। তার ভেতর কমলগঞ্জ উপজেলা অন্যতম। রসময় মোহান্ত সিলেট অঞ্চলের আদিবাসী প্রেক্ষিত ও শব্দকর সমাজ সমীক্ষা পুস্তকে কমলগঞ্জ উপজেলার ১৯৯৫ সালের ডুকলাদের মোট জনসংখ্যা ৪০৭৩ জন উল্লে­খ করেছেন। বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন আর সকল জাতির যেমন হিসেবপত্তর রাষ্ট্রের হদিসে নাই, ডুকলাদের খবর সেভাবেই রাষ্ট্র রাখেনা, রাখার দরকারও মনে করে না কোন কালে। আর দাপুটে ব্যবস্থায় নিরন্তর পর হয়ে ওঠা এইসব মানুষেরা কেবলি আপন ঘর-দুয়ার, জমিন, বাদ্যবাজনা, কাজ, লড়াই ও স্বপ্ন হারাতে থাকেন। উচ্ছেদ আর নিশ্চিহ্ন হতে থাকে মানুষের জনপদ, মানুষেরই দাপটে।

চান্ডালে সে রান্ধে অন্ন, ব্রাহ্মণে সে খায়...


ডুকলাদের কেন্দ্রীয় পেশাই বাদ্য বাজনা। আগে অনেকে হুক্কা খাওয়ার জন্য টিক্কা তৈয়ার করতেন। চোঙা পিঠা খাওয়ার জন্য ডলু ও কালি বাঁশ কাটতে যেতেন পাহাড়-জঙ্গলে। কচি পাঁঠাকে খাসী বানানো আর এঁড়ে বাছুরকে বলদে রূপান্তরিত করার কাজ করতেন। উৎসব আয়োজনে খাবার পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত কলাপাতা আর শটি পাতা জোগাড় করতেন। এখন জঙ্গল রাষ্ট্রের দখলে, এসেছে নিত্যনতুন ব্যবসায়িক ডেকোরেটর, এসেছে সিগারেট কোম্পানি আর পুস্তকি আধুনিক পশু ডাক্তার (!), আর এসেছে মারদাঙ্গা ব্যান্ডপার্টি (!)। ডুকলারা আর সব প্রান্তিক মানুষের মতনই সার্বজনীন প্রাণবৈচিত্র্যে নিজেদের আপন অধিকার হারিয়েছেন। নিশ্চিহ্ন হয়েছে আপন জাতিগত আচার ও ইতিহাস। চলতি সময়ে আপন বাদ্য বাজনাও দখল হয়ে গেছে বহুজাতিক গান-বাজনার বাজারের দাপট দ্বারা। তার উপর সামাজিক কায়দায় বর্ণবৈষম্যতো আছেই। এ অবস্থায় ডুকলাদের চলতি সময়ের অবস্থান এতোটাই প্রান্তিক যে, দাপুটে মানুষেরা যেমন ডুকলাদের নিয়ে যাবতীয় হাসি-ঠাট্টা-তামাশা-মশকরা করে নিপীড়ন করেন তেমনি ডুকলারাও অনেক ক্ষেত্রে আপন পরিচয় দিতে ভয় পান। বাঙালি বর্ণহিন্দুর চিহ্নিতকরনের দাপটের আড়ালে পড়ে আছে ডুকলাদের আপন ধর্মের ইতিহাস। এ ইতিহাস চলতি কায়দায় ইতিহাস হয়ে ওঠে না বলেই ডুকলাদের বুড়া শিব, জগন্নাথও আমাদের আপন হয়ে ওঠেন না। জগন্নাথ বর্তের একটা গানে আছে :

পশ্চিমে বন্দনা করি ঠাকুর জগন্নাথ
যাহার বাজারে রে লরিয়া বিকায় ভাত।
ভাত বিকায়, ব্যাঞ্জন বিকায়, আর বিকায় পিঠা,
জগন্নাথের লাবড়া ব্যাঞ্জন খাইতে লাগে মিঠা।
চান্ডালে সে রান্ধে অন্ন, ব্রাহ্মণে সে খায়,
তেও তো ধার্মিক লোকের জাত নাহি যায়।

নিপীড়িত ডুকলাদের জীবনযাপনেই এইসব বহুপাক্ষিক প্রতিরোধী অদাপটীয় কায়দা বিরাজমান। কিন্তু সেই দিন কী কখনোই ডুকলাদের দেখা হবে এই দাপুটে বর্ণব্যবস্থায় যেদিন চান্ডালে সে রান্ধে অন্ন, ব্রাহ্মণে সে খায়...?

আবার বেজে ওঠুক মঘাই ওঝার ঢোল বাদ্যি...

উপমহাদেশের অনন্য নজির মঘাই ওঝার ঢোল বাদ্যি। ডুকলা মঘাই ওঝার ঢোল বাদ্যি আমাদের বর্ণদাপুটে ব্যবস্থায় কখনোই ইতিহাস নয়। অথচ আমরাই সকল মানুষ সমান, সবার উপরে মানুষ সত্য এইসব ব্যাটাগিরি করি। আমরা ভারতের চুনী কোটালকে আত্মহত্যা করিয়েছিলাম। কারন নিদারুণভাবে অস্পৃশ্য লোধা সমাজের চুনী কোটালের সামনে আমরা দাপুটে বর্ণ সমাজকে হাজির করেছিলাম। আমরা নিত্য চা পান করতে গিয়ে বেমালুম ভুলে যাই আমাদের চা বাগানগুলোতে গিরমিট চুক্তির (আজীবন দাসত্ব চুক্তির) মাধ্যমে আমরা সাঁওতাল-মুন্ডা-ওঁরাও-খাড়িয়া-মাহাতোদের বন্দী করে রেখেছি। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে গিয়ে গায়েব করে ফেলি এই রাষ্ট্রে বাংলা বাদেও আরো ৪৫ বা তারও বেশী জাতির আপন আপন ভাষা আছে। নিজের মায়ের ভাষায় বাঙালির যদি বেঁচে-বেড়ে ওঠার অধিকার থাকে তবে বাদবাকি সকল জাতিগোষ্ঠীরও আছে। আমাদের রাষ্ট্র দুমদাম করে জাতিসংঘের সবকিছু স্বাক্ষর করে দেয়। জাতিসংঘের ১৯৬৬ সালের সকল প্রকার বর্ণবৈষম্য দূরীকরনের(?) লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। প্রতিবছর ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ এখনো এই রাষ্ট্রের পরতে পরতে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ণদাপট। এই জনপদের আপন জ্ঞানকান্ডতো তাই বলে, মানুষের বাইরের চামড়া যাই হোক, রক্ত সবার লাল। আমরা কতজন মানুষ সেটা ভেতর থেকে বিশ্বাস করি। ডুকলা সহ রাষ্ট্রের বর্ণনিপীড়িত সকল মানুষের রক্তই লাল। এক লাল রক্ত কী করে আরেক লাল রক্তকে আজীবন দাস বানাতে চায়? বেজে ওঠুক গ্রাম-জনপদে আবারো মঘাই ওঝার ঢোল বাদ্যি। এই বর্ণদাপুটে সমাজকে আসুন ছিন্নভিন্ন, টুকরো টুকরো করে ফেলি। এখানে আপন শ্বাস ফেলার অধিকার সবার সমান। কেবলমাত্র ডুকলা বলে, এখানে কেউ কারো দখলকৃত দাস নয়। আসুন সকলে সামিল হই আপন প্রতিরোধের পাটাতনে, বর্ণদাপুটে সমাজকে চিহ্নিত করি, লড়াইটা মজবুত করি, এ লড়াই তো আমার-আপনার-ডুকলাদেরও-সকল লাল রক্তের !












অসুখ-বিসুখের দেব-দেবী : মান্দি, কোচ ও হাজং সমাজের নিজ নিজ দলবদ্ধ হওয়ার প্রতীক
দুপুর মিত্র



মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে ধর্ম হচ্ছে -the heart of a heartless world, কিংবা the opium of the masses. ধর্ম প্রসংগে তাঁদের ভাবনা-চিন্তা হলো-এটি অধিপতি শ্রেণীর সহায়ক শক্তি যা সেই শ্রেণীর আধিপত্যকে বৈধ ও স্বাভাবিক করে তোলে। আর বিপরীতভাবে নিপীড়িতদের পারলৌকিক মুক্তির আশা-আকাঙ্খায় ধর্মীয় নিপীড়ন যা অধিপতি শ্রেণীরই নিপীড়ন, তা মেনে নেবার জন্য আহবান করে। মার্কসের মতে ধর্ম একটি কাল্পনিক বিষয়। আর তাই মানুষে মানুষে যৌক্তিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে উঠলেই তার অবসান ঘটবে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।

মার্কসের ধর্ম বিষয়ক এইসব চিন্তার চেয়ে আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে ডুর্খেইমের ধর্ম সম্পর্কিত চিন্তাগুলো যা ১৯০২ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত ÔThe Elementary forms of the Religious life’ এ লেখা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ভাবার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখানো সম্ভব-মার্কস মনে করতেন শিল্পায়ন সমাজতন্ত্রের অনেক পূর্বেই ধর্মকে মিথ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে শিল্পায়ন কখনোই মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারেনি-পারবেও না। বরং এটি আরো ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে যার উদাহরণ এখন আমাদের চোখের সামনে অনেক। যেমন খৃষ্টান্তরিতকরণ ইত্যাদি। মার্কস যেখানে ধর্মকে কাল্পনিক মনে করেন ডুর্খেইম সেখানে বলেন-ধর্মের মত একটি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি বিভ্রান্তি বা মায়া হতে পারে না। তাঁর মতে, বাস্তবে এমন কোনো ধর্ম নেই যেটি মিথ্যা। তাদের নিজ ঢঙে প্রতিটিই সত্য, প্রতিটিই মানব অস্তিত্বের প্রদত্ত দশার ব্যাখ্যা হাজির করে, আলবৎ ভিন্নভাবে। এ কারণে আমরা যখন আদিম ধর্মের দিকে ফিরে তাকাই, আমরা সেগুলোকে খাটো করার জন্য কাজ করি না, কারণ এই ধর্মগুলোও অপরাপর ধর্ম মতন কোনোভাবে কম সম্মানজনক নয়। সেগুলো একই চাহিদায় সাড়া দেয়, একই ভূমিকা পালন করে, সেগুলোর পিছনে একই কারণ রয়েছে; ধর্মীয় জীবনের প্রকৃতি প্রদর্শন করতে সেগুলো একইভাবে সক্ষম । সত্যিই তাই। এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-পার্বনিক মানুষের চাহিদাকেই-জীবনের চাহিদাকেই স্পষ্ট করে তোলে।

মার্কসের সাথে ডুর্খেইমের বেশ কিছু জায়াগায় মিল রয়েছে যেমন-ধর্ম নিপীড়িতদের আদিম বা যন্ত্রণা নিবারক । এখানে ডুর্খেইমের বলেছেন ধর্ম গরীবের সান্ত্বনাদানকারী। কিন্তু মার্কস যেখানে মনে করতেন ধর্ম মানুষের বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে নষ্ট করে, ডুর্খেইম সেখানে মনে করেন ধর্মীয় বিশ্বাস কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসে পুনর্শক্তি যোগায় না-এটি সৃষ্টি-পুণঃসৃষ্টি দুটোই করতে পারে। কাজেই অধিপতি শ্রেণী যে ধর্মের মাধ্যমে নিপীড়ন চালায় তাকে যেমন উৎখাত করতে পারে তেমনি সৃষ্টি করতে পারে বিপ্লবের সম্ভাবনাও।

অর্থাৎ এটি সম্ভব কারণ ডুর্খেইমের মতে ধর্মীয়-আচার অনুষ্ঠান পার্বনাদি কেবলমাত্র বিশ্বাসীদের মধ্যেকার এবং ঈশ্বরের প্রতি বন্ধনকে শক্তিশালী করে না, এটি সদস্যের সাথে দলের বন্ধনকেও শক্তিশালী করে। আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সামাজিক দলটি তার অস্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন হয়। ফলে সমষ্টিগত বোধ ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে নিজেদের একাত্রিত বোধ করেন এবং সম্মিলিত হন। কাজেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিই নিজেদের ঐতিহ্য-সংহতিকে পাকাপোক্ত করতে পারে। আর তাই এখনো ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের ভিতর পালিত হয়ে আসছে নানান ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-পার্বনাদি।

এই লেখায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মান্দি, কোচ ও হাজং সমাজের অসুখ-বিসুখের দেব-দেবীদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় হাজির করছি যা আমাকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতে হয়েছে। এইসব দেব-দেবীর পূজা নানানভাবে তাদের মধ্যেকার ভ্রাতৃত্ববোধকে টিকিয়ে রেখেছে।

মান্দি সমাজের অসুখ-বিসুখের দেব-দেবীদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১. চুরাবুদি : হাত-পা ফুলে গেলে এই পূজা করতে হয়। পূজা করতে ১টি মোরগ ও চু লাগে।
২. জগুরং সিল : মাথা-ব্যথার জন্য পূজা দিতে হয়। চু ও ১ টি মোরগ লাগে।
৩. মিন্না মিদ্দি : বাঁশ দিয়ে দুইটি সাপ বানিয়ে পেটের ব্যথার জন্য রাস্তায় এই পূজা করতে হয়। পূজার জন্য ১ টি মোরগ ও চু লাগে।
৪.দারিচিক : গর্ভপ্রসবের সময় পেটের ব্যথা হলে এই পূজা করতে হয়। ঘরের নকসাস পেছনে পূজা সাজাতে হয়। মোরগ ১ টি লাগে। চু লাগে।
৫.দারিচিক রামানি : গর্ভপ্রসবের সময় পেটের ব্যথা হলে রাস্তায় এই পূজা করতে হয়। এখানেও মোরগ লাগে ১ টি। চু লাগে।
৬.সালবংগী : বাচ্চার জ্বর সবসময় থাকলে সালবংগী পূজা করতে হয়। মোরগ লাগে ১ টি।
৭.হানিং মিদ্দি : বাচ্চার জ্বর হলে মাটির নিচে গর্ত করে মানুষের মত মূর্তি বানিয়ে হানিংমিদ্দি পূজা করতে হয়।
৮.বিদ্দায়ী চিবল : জ্বরের সাথে সাথে শরীর ফুলে গেলে বিদ্দায়ী চিবল পূজা করতে হয়। ফুরা রান্না করে ৩ ভাগ করতে হয়। ১ ভাগ দেবতাকে উৎসর্গ করতে হয় এবং বাকি ২ ভাগ প্রসাদ হিসেবে সবার খেতে হয়। পূজার সময় মোরগের রক্ত দেবতার গায়ে মাখাতে হয়।
৯.চেংদ্দী : বাচ্চা সবসময় কান্নাকাটি করলে এই পূজা করতে হয়। পূজার সময় ১ টি মোরগ লাগে। চু লাগে।
১০.দরিবল : মাথা ঘুরালে করতে হয়। ১ টি মোরগ ও চু লাগে।
১১.দুয়াজাক : শরীর অতিরিক্ত ক্লান্ত হলে দুয়াজাক পূজা করতে হয়। ১ টি মোরগ লাগে ও চু লাগে।
১২.আতিচেলা : বাচ্চা অতিরিক্ত কান্নাকাটি করলে করতে হয়। ১টি মোরগ ও চু’র প্রয়োজন হয়।
১৩.রিসি হানথাম : শরীরে অতিরিক্ত চুলকানি থাকলে করতে হয়। পূজাটি বিকালে করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
১৪.উদোম : পা বা হাত ফুলে গেলে মানুষ বানিয়ে দুইপাশে কলাগাছ গেরে এই পূজা করতে হয়। পূজায় ছাগল ১টি এবং মোরগ ১টি লাগে।
১৫.হানিমাছি : অতিরিক্ত মাথা ঘুরালে করতে হয়। ২টি মোরগ লাগে। ১টি দিয়ে দেবতার গায়ে রক্ত মাখাতে হয়। অপরটি দিয়ে ফুরা রান্না করতে হয় যার ১ ভাগ দেবতার জন্য বাকি ২ ভাগ প্রসাদ হিসেবে সবার খেতে হয়।
১৬.দাগবা বিচ্চিমা : কোনো কারণ ছাড়াই শরীরে সবসময় ক্লান্তি থাকলে এই পূজা করতে হয়। মোরগ ১টি এবং ১ হাড়ি চু লাগে পূজা দিতে।
১৭.জাঙ্খিপাং : অনেক দিন হওয়ার পরও বাচ্চা হাঁটতে না শিখলে ঘরের দরজার সামনে এই পূজা করতে হয়। ২ টি মোরগ লাগে। ১টি দিয়ে দেবতার গায়ে রক্ত মাখানো হয়। অন্যটি দিয়ে ফুরা রান্না করতে হয়। ফুরা ৩ ভাগ করে ১ ভাগ দেবতাকে দিতে হয় বাকি ২ ভাগ প্রসাদ হিসেবে সবার খেতে হয়।
১৮.নককাম : শরীরে বিষ-ব্যথা হলে করতে হয়। পূজার সময় ঘরের প্রত্যেক খুঁটির সাথে আমের পাতা বেঁধে রাখতে হয়। হাঁস ১টি এবং মোরগ ১টি লাগে।
১৯.দাগাল : প্রতি বিকেলে জ্বর হলে এই পূজা করতে হয়। মোরগ ১টি লাগে।
২০.‡`b`v¤^vK : বাচ্চার জ্বর ও বারবার পড়ে যাওয়ার উপসর্গ থাকলে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
২১.বানপাং : বাচ্চা জ্বরের সময় অজ্ঞান হয়ে গেলে করতে হয়। পূজার সময় সাত বোন বানিয়ে খাদাম তৈরি করতে হয়। ১টি হাঁস ও ১টি মোরগ লাগে।
২২.গিদ্দক রুগিবা : অতিরিক্ত গরম থেকে জ্বর হলে করতে হয়। ১টি হাঁস ও ১টি মোরগ লাগে।
২৩.দুরা Avw¤^mx : সকালে এবং দুপুরে জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
২৪.বারিং কল : হাত-পায়ে গর্তের মত ঘা হলে করতে হয়। ১ জোড়া কবুতর লাগে।
২৫.গেরাম : সবসময় শরীরে জ্বর থাকলে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
২৬.চুয়াল আচাকনী : বুক ব্যথা করলে এই পূজা করতে হয়। পূজার সময় মোরগের চোয়াল লাগে। আর কুকুর কেটে রক্ত দেবতার শরীরে মেখে দিতে হয়।
২৭.দুনি চুয়াল : সবসময় ঢেকুর উঠলে করতে হয়।
২৮.হিচানী দমোকনী : অজ্ঞান হয়ে গেলে এই পূজা করতে হয়। খালের উপরে পূজা করতে হয়। ১টি পাঁঠা এবং ১ জোড়া কবুতর লাগে।
২৯.চিব্রেং : কেঁপে কেঁপে জ্বর হলে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৩০. বাঙ্গালস্নি : শরীরে সবসময় জ্বর থাকলে করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৩১. রিসি নকমা : সারা শরীরে ঘা হলে করতে হয়। ১টি পাঁঠা ও ১টি মুরগি লাগে। চু লাগে ৩ থেকে ৪ টি।
৩২. রিসি হানথাম : শরীর বেশি চুলকালে বিকেলে এই পূজা করতে হয়। মোরগ লাগে ১টি।
৩৩.মিককাসি : চোখে চুলকানিসহ ব্যথা হলে করতে হয়। মোরগ লাগে ১টি।
৩৪.সালবামন ফ্রিং : যখন-তখন শরীর ফুলে গেলে। মুখ বাঁকা হয়ে গেলে এই পূজা দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে। সকালে এই পূজা করতে হয়।
৩৫.সালবামন হানথাম : মুখ ফুলে গেলে এই পূজা করতে হয়। বিকালে পূজা দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৩৬.দালওয়া চিরিং : পা-মুখ ফুলে গেলে করতে হয়। হাঁস ১টি ও মোরগ ১টি লাগে। ধানের গোলা ঘরের সামনে এই পূজা দিতে হয়।
৩৭.সুয়াবারি জাংগিম : শরীর হলদে রঙ হয়ে গেলে গোয়াল ঘরের মধ্যে এই পূজা করতে হয়। ১টি হাঁস ও ১টি মোরগ লাগে।
৩৮.রাককাসি পাচাংগ্নি : দিন রাত সবসময় জ্বর হলে করতে হয়। খাদাম বানাতে হয় দুইটি। একটি ঘরের সামনে এবং অপরটি ঘরের পাশে। বড় মোরগ দিয়ে এই পূজা দিতে হয়।
৩৯.দুমাগিবারিম্মা : প্রসূতির সন্তান হবার পর ফুল না পড়লে এই পূজা করতে হয়। পূজার সময় ১টি বড় মোরগ লাগে। মোরগটি দিয়ে ঘরের দরজায় বাড়ি দিতে হয়।
৪০.মারাংরককা : প্রসূতির বাচ্চা হওয়া ও ফুল পরার পর অসুখ-বিসুখ না হওয়ার জন্য পূজা করতে হয়। পূজার সময় মুরগির ডিম লাগে।
৪১.হাপুরু মিদ্দি : কানে কম শুনলে মোরগ দিয়ে পূজা দিতে হয়।
৪২. সালজং দুবক নিয়া : শরীর অবশ হয়ে গেলে পূজা দিতে হয়। ১টি লাল মোরগ লাগে।
৪৩.গনচুহাদক : বাচ্চা সবসময় কাঁদতে থাকলে মোরগ দিয়ে পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৪৪.গনচু নকসাম : বাচ্চা পাগলামি করে কাঁদলে ঘরের পেছনে পূজা দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৪৫.হারেদ্দা : শরীরে ঘা হলে পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৪৬.মইলা আমোয়া : বাচ্চা হয়ে শুধু মারা গেলে পূজা করতে হয়। শ্যাঁওড়া গাছের নিচে ১টি পাঁঠা এবং ১টি মোরগ দিয়ে এই পূজা করতে হয়।
৪৭.বুরগিদিক : বাচ্চা ঘন ঘন কাঁদলে পূজা দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৪৮.দুহাজাক : বাচ্চা হাত-পা ছেড়ে দিয়ে কাঁদলে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৪৯.সালবংগি : প্রত্যেকদিন দুপুরে জ্বর হলে ঘরের চালের উপর খাদাম বসিয়ে পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৫০.খাণ্ডাব গুয়েরা : শরীরে ঠোসা পরলে করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৫১. তংরেংমা : মানুষের মাথা সবসময় ঘুরলে এবং পড়ার উপসর্গ হলে এই পূজা দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৫২.গান্দি গলদাক : সবসময় মাথা-ব্যথা হলে পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৫৩.আমিন্দা : কেঁপে কেঁপে জ্বর হলে পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৫৪.আসংদেননা : গ্রামের মানুষে একের পর এক জ্বর হয়ে মরতে থাকলে এই পূজা করতে হয়। ১টি পাঁঠা ও ১টি মোরগ লাগে।
৫৫.শনি মারাং রগ্গা : নাক দিয়ে রক্ত পড়লে পূজা করতে হয়।
৫৬.দারিচিক ফ্রিং দমকনা : সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় পেটের ব্যথা হলে সকালে পূজা করতে হয়। ১টি পাঁঠা ও ১টি মোরগ লাগে।
৫৭.বরিশাল : জ্বর হয়ে ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে পড়লে এই পূজা করতে হয়। পূজায় ১টি পাঁঠা, খই, কলা, চিনি, চন্দন প্রভৃতি লাগে।
৫৮.দেনবিলসিয়া : জ্বর হলে পূজা করতে হয়। যেদিন পূজা সেদিনই খাদাম বানাতে হয়। পূজায় ভাত দিয়ে খামালকে ঢিল ছুঁড়তে হয়। ১টি শুকর লাগে।
৫৯.মাইছা আমোয়া : মানুষের জ্বর হবার পাগলের মত অবস্থা হলে পূজা করতে হয়। নদীর ধারে যে কোন মাছ ও পাঁঠা দিয়ে বলি দিতে হয়।
৬০.মিক্কাসি : চোখ ব্যথা ও চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়লে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৬১.দুব্রিংচা কাইচু গারিয়া : খুব দ্রুত শরীর ফুলে গেলে এবং ব্যথা হলে করতে হয়। ১টি লাল মোরগ লাগে।
৬২.জাশুতা : জ্বর হলে মানসিক করে পূজা করতে হয়।
৬৩.হাঙ্খি মিদ্দি : থেকে থেকে জ্বর হলে জলের ধারে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৬৪.চলসি : মুখ কিংবা গাল ফুলে গেলে মোরগ অথবা ছাগল দিয়ে পূজা করতে হয়।
৬৫.চিয়াবেং : কান বন্ধ হয়ে গেলে ১টি মোরগ দিয়ে পূজা করতে হয়।
৬৬.চান্দ : রাতে জ্বর হলে এই পূজা করতে হয়।
৬৭. ওয়াককারাং : পায়ে ঘা হলে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৬৮. বন দেবতা : অজ্ঞান হয়ে গেলে ১টি মোরগ অথবা ১টি শুকর দিয়ে এই পূজা করতে হয়।
৬৯.সুরিগিতিং : অসময়ে মাসিক হলে ১টি মোরগ দিয়ে করতে হয়।
৭০. হাসি আমোয়া : কেঁপে কেঁপে জ্বর হলে মাটি দিয়ে গরু বানিয়ে পূজা দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৭১.কৃষ্ণ ঠাকুর : বাচ্চার ঘন ঘন জ্বর হলে আবার সেরে গেলে এই পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৭২.শুসিমি সংগরচা : মাথার চুল জট বেধে জ্বর হলে করতে হয়। ১টি শুকর এবং ৩/৪টি মোরগ লাগে।
৭৩.ইস্কাল ওয়াদা : পায়খানা হয় না এবং ঘন ঘন বমি হয়। এরূপ হলে রাস্তায় এই পূজা করতে হয়।
৭৪.খংখান মিদ্দি : ঘন ঘন ঢেকুর হলে করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৭৫.দুরাহারাগাথ : বাচ্চা নেড়া হয়ে হাঁটলে মাটি উঁচু করে পূজা করতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৭৬.সাংকা বালা : ঘন ঘন জ্বর হলে দিতে হয়। ১টি মোরগ লাগে।
৭৭.অলিবক : জণ্ডিস হলে করতে হয়। ১টি কবুতর লাগে। গার রোগ হয় সে প্রসাদ খাইতে পারে না।
৭৮.মেঙ্গং মিদ্দি : পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হলে করতে হয়। রাস্তার ধারে ১টি মোরগ দিয়ে এই পূজা দিতে হয়।
৭৯. নকনি মিদ্দি : কেঁপে কেঁপে জ্বর হলে করতে হয়। ৩/৪টি চু, ৪টি মোরগ, ১টি শুকর অথবা ১টি পাঁঠা লাগে।
৮০. `yiv¤^ywm : বাচ্চার জ্বর না ছাড়লে ১টি মোরগ দিয়ে এই পূজা করতে হয়।



কোচ সমাজের অসুখ-বিসুখের দেব-দেবীর নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১.কাক মাঞ্চি : জ্বর হলে পূজা করতে হয়। দেবতার বাহন হাতি। আজুম গোত্রের যারা, তারা এই পূজা ঘরের বাইরে এবং সিমসাং গোত্রের যারা তারা ঘরের ভিতরে পূজা করে।
২.যারাং : ম্যালেরিয়া হলে এই পূজা করতে হয়। এর বাহন ময়ূর। মোরগ দিয়ে পূজা করতে হয়।
৩.বারুম খোলা : শরীরের ঘা ভালো না হলে হাঁস দিয়ে পূজা করতে হয়।
৪.মুইলা : বাচ্চা ভূমিষ্ট হবার পর হঠাৎ করে মারা না যাওয়ার জন্য পূজা দিতে হয়।
৫.ওয়াচিং দিল্লী : আমাশয়ের কারণে পেটের ব্যথা হলে বাঁশের চাকু বানিয়ে মোরগ কেটে এই পূজা করতে হয়।
৬.কামারতুকসাং : হাঁপানির মত কাঁশ হয়ে না গেলে ছাগল অথবা পাঁঠা বলি দিয়ে পূজা করতে হয়। পূজায় অব্যবহৃত হাল চাষের ফলা লাগে।
৭.দুখুমবনিতা : মাথা ব্যথা হলে পাঠা বলি দিয়ে পূজা করতে হয়।
৮.জগবোছা : বুকে ব্যথা হলে এই পূজা করতে হয়। মাদার গাছের ছুড়ি বানিয়ে কবুতর বলি দিতে হয়।
৯.লামনি ওয়াই : পা ঝিম ঝিম করলে কবুতর দিয়ে পূজা করতে হয়।
১০.ঠ্যাংগামারা দেবতা : পা নেড়া হয়ে গেলে ভালো হবার জন্য পূজা করতে হয়। পা পাইন গাছ ও পাট দিয়ে শক্ত করে বেধে রাখতে হয়। রাস্তায় কবুতর বলির মাধ্যমে এই পূজা করতে হয়।
১১.হুদুম ওয়াই : শরীর ব্যথা করলে এই পূজা করতে হয়। পূজায় পানের ২টি ডাল লাগে।

হাজং সমাজের অসুখ-বিসুখের দেব-দেবীর নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১.মইলা দেও : বাচ্চা প্রসবের পর পূজা করতে হয়। যেন বাচ্চার কোনো রোগ-বালাই না হয়। ছাগল অথবা পাঁঠা বলি দিতে হয়।
২.হাও ঠাকুর : অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য পূজা করতে হয়। এই দেবতার বাহন গরু।
৩.হাওয়া দেও : শক্তি বৃদ্ধির জন্য পূজা করা হয়।
৪.ডাইনি : রোগ ভালো না হলে পাখি, ভেড়া অথবা হাঁস মানত করে রাস্তার তেমাথা মোড়ে পূজা করতে হয়।
৫. পতে দেও : বাচ্চা মার দুধ না খেলে মানসিক করে পূজা করা হয়।

অসুখ-বিসুখের দেব-দেবী ও মান্দি-কোচ-হাজংদের ধর্মীয় দর্শন :


মান্দি-কোচ-হাজং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার প্রত্যেকের ধর্মে অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের দার্শনিক চিন্তা কাজ করেছে। তাঁরা অসুখ-বিসুখকে পাপের শাস্তি হিসেবে দেখেন, দেখেন দেব-দেবীর অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে। এই সব ধর্মে অসুখ-বিসুখ সম্পর্কিত শত্রুর ধারণাও বিদ্যমান, যেখানে মনে করা হয় কবিরাজ বা এরকম শ্রেণীর লোক যারা তান্ত্রিক; তারা শত্রুতা বসত মানুষের অসুখ-বিসুখ ঘটাতে পারেন।

মান্দি, কোচ ও হাজং ধর্মীয় মতে মানুষের মৃত্যু আবশ্যিক হলেও আত্মা অমর। এই আত্মা পূর্বজন্মের ফলস্বরূপ মানুষ অথবা জীবজন্তু হিসেবে পৃথিবীতে আসেন। পূর্ব জন্মে পাপের সম্পূর্ণ শাস্তি না হলে তা ইহজন্মে অসুখ-বিসুখ হিসেবে ভোগ করতে হয়। কখনো কখনো ইহ জন্মেই মানুষ পাপের শাস্তি অসুখ-বিসুখের মাধ্যমে ভোগ করে।

এই সব ধর্মীয় মতে যেহেতু সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু তাদের সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ম মাফিক স্মরণ করা উচিত। কেউ যদি তাঁদের যথা নিয়মে স্মরণ না করেন, তাহলে তা পাপের পর্যায়ে পড়ে এবং পাপের শাস্তি হিসেবে অসুখ-বিসুখও হতে পারে। এইসব একই ধরনের দর্শনচর্চা মান্দি, কোচ ও হাজংদেও পৃথকভাবে দলবদ্ধ করে তোলে।

অসুখ-বিসুখের দেব-দেবী মান্দি, কোচ ও হাজং সমাজের নিজ নিজ দলবদ্ধ হওয়ার প্রতীক :

মান্দি সমাজে অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তির জন্য যে আমোয়া বা পূজা করা হয়, তা সাধারণত বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় (কিমাণ্ডা) করতে হয়। সেখানে ৪টি বাঁশ পুঁততে হয়। ঐ স্থান মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করা হয়। খামাল বা পুরোহিত রোগীকে পুরুষ হলে কিমান্ডার ডান দিকে আর মেয়ে হলে বাম দিকে বসিয়ে মন্ত্রপাঠ করেন। যেদিন আমোয়া বা পূজা সেদিন অসুস্থ ব্যক্তির বাসায় পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাইকে শুকর, মোরগ এবং চু দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এ সময় ঐ বাসায় নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে খামাল এবং পরে সকল বয়সের নারী-পুরুষ এই নাচ-গানে অংশগ্রহণ করেন, যা তাদের মধ্যেকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।

হাজং ও কোচ সমাজেও পূজা-পার্বনের দিন সকল শিশু-কিশোর-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নানান নাচ-গান ও আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন যাকে আমরা নিজেদের দলবদ্ধ হওয়া ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিকাশের প্রতীক হয়েই ফুটে উঠতে দেখি।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, এই সব দেব-দেবীর নাম ও আচারাদি সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি অনেক আচার-অনুষ্ঠানই হারিয়ে যেতে বসেছে। নানান জনের সাথে আলাপ করতে গিয়ে মনে হয়েছে এগুলো হারানোর পিছনে যতোটা না অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দায়ি, তারচেয়ে বেশি দায়ি নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস নিজেরাই খাটো করে দেখা। কেননা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উত্তরণের জন্য ধর্মান্তরিত হওয়া ছাড়াও আরো অনেক পথ রয়েছে। ধর্মই যেখানে বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে নিজধর্মকে অযৌক্তিক বলে আরেকটি ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া কতখানি যৌক্তিক-আপনারা কি একবার ভেবে দেখবেন ?


শ্রদ্ধাষ্পদেষু
1. জনিক নকরেক, চুনিয়া, মধুপুর, টাঙ্গাইল।
2. মতিলাল হাজং, সুসংদূর্গাাপুর, নেত্রকোনা।
3. সহিন মৃ, চুনিয়া, মধুপুর, টাঙ্গাইল।
4. নেত্তা নকরেক, হাগুরাকুরি, মধুপুর, টাঙ্গাইল।
5. হাজং অশ্বিনী কুমার রায়, লাঙ্গলকোরা, ধোবাউড়া, ময়মনসিংহ।
6. স্মরেন কোচ, খলচান্দা, নালিতাবাড়ি, শেরপুর।
7. সুধীর হাজং, সমশ্চুরা, নালিতাবাড়ি শেরপুর।
8. যুগল কিশোর কোচ, রাংটিয়া, ঝিনাইগাতি, শেরপুর।
9. পঙ্কজ দেবর্ষি, লাঙ্গলজোড়া, ধোবাউড়া, ময়মনসিংহ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
১.পরাগ রিছিল, জয়রামকুরা, হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ।
২.বচন নকরেক, চুনিয়া, মধুপুর, টাঙ্গাইল।
৩.সৃজন সাংমা, গবেষণা কর্মকর্তা, বিরিশিরি কালচারাল একাডেমী, নেত্রকোনা।
ঊল্লেখ্যঃ জানিরা, ১৪তম সংখ্যা, সম্পাদক-সৃজন সাংমা, প্রকাশকাল-১৯৯৭, জুন।

চাকমা নাটক ও জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল
মৃত্তিকা চাকমা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই অবিভক্ত পার্বত্য চট্রগ্রামে আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চার একটা জোয়ার এসেছিল। এ জোয়ারের প্রধান ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ছাত্রসমাজ আর পার্বত্য চট্রগ্রামের একমাত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী। বলতে গেলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ ঘটে-নাচে, গানে, পোষাক-পরিচ্ছদে। সুখের বিষয় এ ধারা এখনো প্রবাহমান।

ক্রমিকনং-নাটকের নাম-নাট্যকারের নাম-মঞ্চায়ন-সন

১.আনাত্‌ ভাজি উধে কামু-চিরজ্যোতি চাকমা-১ বার-১৯৮৩
২.যেযে দিনত কাল-শান্তিময় চাকমা-২ বার-১৯৮৪
৩.বিঝু রামর স্বর্গত্ যানা-শান্তিময় চাকমা-২ বার-১৯৮৫
৪.আন্দারত জুনিপহর্‌-শান্তিময় চাকমা-১ বার-১৯৮৬
৫.দেবংসি আধর কালা ছাবা-মৃত্তিকা চাকমা-২ বার-১৯৮৯
৬.গোঝেন-মৃত্তিকা চাকমা-১ বার-১৯৯০
৭মহেন্দ্রর বনভাজ-মৃত্তিকা চাকমা-২ বার-১৯৯১
৮.এক জুর মানেক-মৃত্তিকা চাকমা-১ বার-১৯৯২
৯.অয় নয়া বৈদ্য-ডা. ভগদত্ত খীসা-১ বার-১৯৯৩
১০.ঝরা পাদার জীংকানি-শান্তিময় চাকমা-২ বার-১৯৯৪
১১.জোঘ্য-মৃত্তিকা চাকমা-১ বার-১৯৯৪
১২.অদত্&-ঝিমিত ঝিমিত চাকমা-১ বার-১৯৯৫
১৩.আন্দালত পহ্‌র&-ঝিমিত ঝিমিত চাকমা-১ বার-১৯৯৬
১৪.হককানীর ধন পানা-মৃত্তিকা চাকমা-৯ বার-১৯৯৯
১৫.কাত্তোন-ঝিমিত ঝিমিত চাকমা-২ বার-২০০০
১৬.এগাত্তুরর তরনী-মৃত্তিকা চাকমা-২ বার-২০০১
১৭.ভূত~মৃত্তিকা চাকমা-২ বার-২০০২
১৮.দুলু কুমোরী-তরুন চাকমা-৪ বার-২০০৩
১৯.অঈনজেব-ঝিমিত ঝিমিত চাকমা-২ বার-২০০৪
২০.চিত্রা নদী পারে-মৃত্তিকা চাকমা-৩বার-২০০৫

স্বাধীনতার দশ বছর পর ১৯৮১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একদল পড়ুয়া তরুনদের মাধ্যমে জন্ম হয় রাঙ্গামাটি ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল-বর্তমানে জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল (জাক)। পার্বত্য চট্রগ্রামের আদিবাসী নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি চাকমা ভাষায় নাট্য চর্চার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে যতগুলো নাটক মঞ্চায়ন হয়েছিল তার পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরা হলো-

৮০ দশকের শুরুতেই জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল (জাক) যখন চাকমা নাটক মঞ্চায়নের কাজ শুরু করে তখন রাঙ্গামাটির গুটিকয়েক তথাকথিত আদিবাসী জ্ঞানীজন-গুণীজন জাক এর কর্মীদের উপর সমালোচনায় উন্মুখ। তাঁদের ধারণা নাটক মানে শুধু বাংলা ভাষায়, কী মঞ্চে কী লেখ্য রূপে! কীভাবে সম্ভব চাকমা ভাষা দিয়ে চাকমা নাটক! মোটকথা তাঁদের বক্তব্য- যারা চাকমা নাটকের নামে মঞ্চে অভিনয় করবে তারা পাগল ছাড়া কিছুই নয় । এভাবে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা সহ্য করে জাক এগিয়ে যায়। অপর দিকে উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনিষ্টিটিউট-উসাইও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিলকে। এবং এভাবে পার্বত্য চট্রগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে চাকমা নাটকের বিভিন্ন দিক। এরপর চাকমা নাটক আন্দোলনের চলার পথে এগিয়ে আসেন ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের সহকারী পরিচালক গোলাম হাবিবুর রহমান মধু (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)। তাঁর প্রচেষ্টায় সপ্তাহ ব্যাপী রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমীতে আধুনিক নাটকের কলাকৌশল সম্পর্কে কর্মশালা সমাপ্ত হয়। তাঁর কর্মশালার উপর ভিত্তি করে জাক পরবর্তীতে তাদের নাটকগুলোতে আঙ্গিকগত দিক পরিবর্তন ঘটায়।

১৯৯১ সাল। দেশের সিংহাসন বদল হয়। সামরিক শাসকের হাত থেকে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে। ঠিক ঐ সময়টাতে বিঝুর সময় জাক মঞ্চায়ন করে মৃত্তিকা চাকমা রচিত মহেন্দ্রর বনভাজ । রাঙ্গামাটিতে নাটকটির সফল মঞ্চায়ন দেখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সহকারী পরিচালক গোলাম হাবিবুর রহমান জাক কে আমন্ত্রণ জানান ঢাকাতে নাটকটি মঞ্চায়িত করার। আর এভাবেই ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে প্রথম চাকমা নাটক মঞ্চায়নের ফটক উন্মোচিত হয়। নাটকটির অংশ বিশেষ নিম্নরূপঃ

মহেন্দ্রর বনভাজ
মৃত্তিকা চাকমা

দৃশ্য- ১
অক্ত: সাঝন্যা মাধান
জাগাঃ গভীন ঝার
[ গাঝ-বাঝর ঝুব সেরে অনুমহর ৫০/৬০ বজস্যা উক্ক মিলে (মহেন্দ্রর মা) কোঙেই কোঙেই থাক্কে দেঘা যেব। সে সেরে অক্ত অক্ত জন্তুর জানুয়াররর শুনযেব। মিলেবোর ধাগেদী উক্ক কুলা্যাঙ দেঘা যেবÕ]

মাঃ ( উদ্যা-ভূদ্যা বাদে) ইঁ-হিঁ, ও মা, মাআ মারে, ও-উ-উমা, মারে। অযাঁ কবাল, ও কবাল। কবাল, ও তুই কিয়ে এধক সেয়ান্যান অহ্‌লে-ই-ই। এ্যাঁ কবাল? ( মিলেবোর আহ্‌বিলেজর সমারে সমারে জীবজন্তুর-র উন শুন যেব। সেরেউনে মিলেবোর কান পাদি শুনি থেব )-মহেন্দ্র, মহেন্দ্র-অ-অ! আঁ পুদ, ও পুদ, কুধু যাজ্‌? মহেন...
( ফাদা তালি দিয়ে কাবরান তিঙতিঙ্যা গোরি মু-উড়িব'। হাক্কন পর মহেন্দ্র গাঞ্জা পিন্যা, তালি দিত্যা শিথুম উক্ক উস্যা, তাগল এক্কান আহ্‌ধত আর কানাত কয়উক্ক কলাত্তুর বোগোলী, সে--- বনর লদা-পাদা লোই, তা মারে দুরত্তুন দাঘী দাঘী এব')
মহেন্দ্রঃ মা, ও-মা, মা!( পঝানী থব) মা ঘুম গেলে নাকি? ও মা ( এবার কারবান উল্লেই তামারে কবালত ধোরী চেই ) মা, আ কি কেয়্যান উম্‌ উম্‌ পাঙর? জ্বর উথ্যাদে মা?
মাঃ ( এবার তা মা এক্কা চাত্তেই) মহেন, এলেদে বা?
মহেনঃ অয় মা।
মাঃ আ এধক্কন কুধু যেয়স বা? রেত অল্লি, মুই দ ডাক্কে ডাক্কে অরান অলুং।
মহেনঃ কি গোত্তুং মা । এ্যাই-এ-মা, কলাত্থুর, বগলী আন্যং। উদ্‌ মা খেদং মালে।
( পোজ্যাতুন মহেন্দ্র তা মারে ধোরি তুলিব)
-মা, আ কেয়্যান এধক কিয়ে উম্‌ উম্‌ ওইয়্যা?
মাঃ আঁ পুদ, দুগর পিরে উকুল্যে অয়দ্যা আয়!
মহেনঃ দারুঅদ নচিনং, তেহ্‌ কি অভ মা?
মাঃ কি আর অভ। ( লাম্বা উক্ক-ব নিজেস ফেলেব)
মহেনঃ রেদ অল্লি মা, কুঝি কুঝি থুরুন খেইল। ( কলাত্থুরুন তা-মারে বেহ বেই দিব।)
মাঃ আ, তুই ন খেবে বা? ( পাঘোর শুলিব)
মহেনঃ মুই সিধু খেয়ং। পেদ নপুরের আর। মা, তুই খা।
মাঃ কোদ্দুরত যেয়স বা?
মহেনঃ (দুরত গোরি দেঘেই দিব) উই-ও-বো, উন্দি দোনাবত যে কলাবনান দেঘর, এ্যাঁ সিধু।
মাঃ ও মারে, মা, আ-এদ্দুরত কিত্তে যেয়স ! নারে না, সেয়ন্যান গোরি ন যেইস আর। খেই-ন'পেলেও ন' যেইস।
মহেনঃ চিদে ন'গোরিস মা! বানা ভগবান ইধু সুরনগর, আমি যেন মাদি-মাদি এই বনভাঝত্তুন মুক্ত ওই পারিয়।
মাঃ আঁ পুদ! বনভাঝত পোজ্জোইদে পোজ্জেই, আঝা-দ' ন'গরঙর, মুক্ত ওই পারিবং।
মহেনঃ বাজি থেলে একদিন অভঙ। ও...হো...মা তুই হাক্কন থেই পারিবেনি? এক্কা গজ্জংগাজ' তেলান আন্দুগঙই।
মাঃ নারে পুদ, না! এ্যা-রেদি বেলি মায়!
মহেনঃ বেজ্‌ দুরত নয়, যেমও এম্মোই। ( আঙুল্লোই দেঘেই দিব)
- উ...ই...ই...ও...য়ো..বো।
মাঃ কি গত্ত, থোক।
মহেনঃ চেরাক জ্বালেই পারিবঙ-দ'মা।
মাঃ এই ঘুর আন্দারত চেরাক জ্বালেই কি উধো পেব'?
মহেনঃ অন্তত: আমা মুজঙান-দ' অভ'।
মাঃ যা সালেন। ( মহেন্দ্র তাগলান আহধলোই যেবগেহ'। ইন্দি তা মা কলাত্থুর খানা মুমগোরি বোগালীত্তুন চিবি পানি পিয়েই খেই আর, কাবরান উড়ি ঘুমত পোরিব। হাক্কন পর জিয়েন পায়রর শুন' যেব'। তারপর বোম্বা উক্ক ধোরেই মহেন্দ্র এবগোই। আহ্‌ধত কিছু লদি জাবুর ও থেব।)
মহেনঃ মা, ও মা, ঘুম গেলে না কি? মা-
মাঃ ( কাবরান উল্লেই) এলেদে বা? কোই কত্তমান পেয়স?
মহেনঃ ( বোম্বাবো দেঘেই) ইয়ত বেক্কান ভোরেয়ং মা। দর-মা, ধোরিস্‌ । ( মহেন্দ্র বোম্বাবো তা মারে দিব)
-ইন্দি দেঘা মা, মুই তরে দারু কাদি দোং।
মাঃ থোক্‌ থোক্‌, সে-নচিন্যা-ন' মেল। কি পাদা উদিজ নেই!
মহেনঃ বনর লদা পাদা ফেলা ন যায়, এক্কান নয় এক্কান গুন থায়।
মাঃ পুদ সেদক্কানি নয়, বোম্বাবো আগে ধরা; আগে ইত্তুন লোড়িয়।
মহেনঃ আ কিয়ে মা?
মাঃ মত্তুন এব্রে কেজান কেজান মনে অত্তে।
মহেনঃ মা, কুধু আর যেবং, যিদু যেদং সাদ্‌ ঝার-জঙ্গল লাঘত পেবং।
( আর জিয়েন পায়র সারা শব্দ শুন যেব। আর সিয়েবেজ্‌ তা মা চক্কমক্ক অভ)
মাঃ বা, ইত্তুন গেলে দোল অভ দে। মুই দরাঙর। যেই, বা যেই।
মহেনঃ যেই আয় সালেন মা, দে-উদ।
( তারা পঝা বিরোন তোগেই-বিগেই লেই, মহেন্দ্র ও তা পঝানি বাঙা-মোস্যা গোরি লোই বোম্বাবো এক আহ্‌ধে, আর তাগলান আর এক আহ্‌ধে ধোরি লারে লারে আহ্‌ধা ধোরিবেক। )

২৫ জনের একটা বিশাল গ্রুপ নিয়ে ঢাকার বুকে নাটক মঞ্চায়ন করে আসা বিরাট ব্যাপার। তবে এ সাফল্যের পেছনে রাঙ্গামাটি, চট্রগ্রাম, ঢাকায় স্বজাতীয়দের অনেক প্রেরণা রয়েছে। সুখের বিষয় উক্ত নাটকটি জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল (জাক) পড়ম অডিও এবং ভিডিও ধারণ করে ঐ শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে। প্রায় সাত বছর পর আবার বিঝুর সময় পরিবেশিত ঝিমিত ঝিমিত চাকমা রচিত ও নির্দেশিত আন্দালত পহ্‌র' মঞ্চে ভিডিও ধারণ করা হয়। আর এভাবেই বহি:দৃশ্যের চিত্রায়নও করতে সক্ষম হয় জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল।

জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিলের নাট্যচর্চা ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। তার মধ্যে প্রথম এগিয়ে আসে আরণ্যক নাট্যদল । একসময় উক্ত সংগঠনের এক সিনিয়র কর্মী পাভেল আজাদ (আজাদ আবুল কালাম) জাক-র নাট্য কর্মীদের নিয়ে সপ্তাহব্যাপী নাট্য কর্মশালা সমাপ্ত করেন। বর্তমানে তিনি প্রাচ্য নাট এর কর্ণধার হয়ে সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর ঐ কর্মশালার জন্য জাক-র নাট্যকর্মীরা তাকে আজীবন স্মরণ রাখবে।

অশান্ত পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্ত হলো। ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর বদলে গেলো পার্বত্য অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত। বদলে গেলো জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিলের নাট্য গতিধারা। এই পরিবর্তনের নতুন ধারা পরিস্ফুট হয় হককানির ধন পানা নাটকে। ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে এই নাটকটি মঞ্চায়িত হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মিরপুর স্টেডিয়াম, মহিলা সমিতি মঞ্চ সহ কয়েকটি জায়গায়। নিচে হককানী ধন পানা নাটকের একটি দৃশ্যের কিছু সংলাপ পত্রস্থ করা হলো-

দৃশ্য-৩
অক্তঃ সাঝন্যা মাধান।
জাগাঃ মনতুলী মোন।
[jvBU এযানার সমারে কেড়ংচানে তা বাঙামোচ্যা ভুদিবোলোই তা আহ্‌ধানার ¯^fv‡e জুরি বাজেই বাজেই এব। এ্যান সলাত পদ পাজাবত দেঘে উক্ক কলাপাদা উগুরে ভাদপোই। সিভে আদেক্যা গরি দেঘী খুঝি অহয়। আ আমক ওই সাগত সাগত উগুরী উধে। এ্যানেহ্‌ এ্যানেহ্‌ ভাত্তুন খেবার ভাত্তুন ভালীগরি লাচোচ্‌ জাগে। এ্যাহন গত্তে গত্তে ভুদশুদ্দো মেক্কের গরি বঝি ভাত্তুন খা ধোরিবÕ]
কেড়ং চানঃ ( তা মুদ্রা দুঝে কেড়ংকাড়াং ওই )
-এ্যাঁহ। ( আমক ওই হাক্কন পর )
-ভাদ। ঘেক্‌ঘেস্যাক ভাত্তেই। ইধু কি মানুজ আঘন? ( এক্কা আমক ওই ভাবিব )
-মানুষ্য কন মাদিত্‌ গেল নি কি! (ভাদ ভাইপো রেনী চায় আর ধুব গিলে)
-গম তোন আঘে। কাঙারাচাক বাত্যা অভদে পারাপাং। (কায় নিনে চুমি চানার পর)
-হিঁ: চিধোল দিএ্যা মরিচ বাত্যা। হাক্কে মা দেবী লুমিলেগী থুত্‌তুরি খেম্মে।
(এবার ডেনে-বাঙে লুচ্চো মু গরি রেনী চেই পাগুলুং পাগুলুং খা ধরিব। এযান অক্তত হককানী এযাই)
হককানীঃ টে ট্‌ টে রেক। (কেড়ংচানে উগুড়ি উধি ঝরাদত্‌ ভাত্তুন ঝারেই ফেলেই)
এ ভাত্তুন কুধু পেলে?
কেড়ং চানঃ (থদ-মদ ওই) এ-এযা-এ ঘুথ্যাবোত মা-দেবী।
হককানীঃ (আমক ওই) ঘুথ্যাবোত! ডসউন তুই খত্তে? ডছ-ছি! ই ঘিনাচ? কি ভাত্তে ইধিজ নেই, এদা ডাক্যে, না কন এক্কান গোস্যা! তুই মুনিচ্চর ন অহভে!
কেড়ং চানঃ মুরো উধি লামি, উধি লামি পেদ পরায় অহ্‌বানে, পেয়উং খাঙত্তে। মা-দেবী মুই তত্তুন হেমা চাঙর। এব্রে ন খেম আর। এই কানত ধোরি সমত হাঙর।
হককানীঃ একজনর এ্যাহ্‌ধা গোচ্যা ভাদপোই তুই কেনে হেই পাবচ! এুই ভাবী কুল ন পাঙর। ছিঃ...
কেড়ং চানঃ এ্যানে দ অহয়। একজনর ভাদপোই অন্যজনে হেই দেনা অজিত নয়।
হককানীঃ তে? আ তুই কিয়ে মেধেরা হঅর?
কেড়ং চানঃ কি গোত্তুং মা-দেবী, লুভ সামেলেই ন পারং।
হককানীঃ “লুভে পাব পাবে মৃত্য- হবর পাচ?
কেড়ং চানঃ ( এঘক গরি থেঙত পরি) মা-দেবী যা গোচ্যং আর ন গরিম। মরে পাব হোন্দেই দে।
হককানীঃ (রাগ দেঘেই) অ-হ্‌-য়! তুই পাব গরিদে মুই হোন্দেই দিদুং।
কেড়ং চানঃ ( থেঙত বেড়েই ধরি) মুই ইমে হাঙর মা-দেবী।
হককানীঃ ইম্‌েহ! তরে আর এক খেপ দেঘং। (গিয়েরে কোই থেঙান তুলি নি)

(এবার সরান পেই লুচ্ছো মু গোরি হককানরি পিজে পিজে যেব গোই) বাত্তি যারেবাক।

২০০০ সালের শেষ প্রান্তে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সহযোগিতায় ঝিমিত ঝিমিত চাকমা রচিত কাত্তোন নাটকটি ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে বিপুল সাড়া জাগায়।

মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি জাক নাট্যকর্মীরা ঝিমিত ঝিমিত চাকমা রচিত আন্দালত পহ্‌র নাটকটি সুপার ভিএসএস ক্যামেরার মাধ্যমে বহিঃদৃশ্য ধারণের মাধ্যমে টিলিফিল্ম নিমার্ণে সক্ষম হয়। বলতে গেলে শুধু চাকমা সংস্কৃতি অঙ্গন নয়, গোটা জুম্ম সংস্কৃতির জন্য এটি একটি বড় কাজ। এর পরবর্তীতে শ্রী পরেশ নাথ চাকমা ও পুস্পিতা খীসার সহায়তায় ১৯৯৮ সালে জানুয়ারি ৭ তারিখ চট্রগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রে একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে দর্শকদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায়। মোটামুটি এভাবে এগিয়ে চলেছে চাকমা নাট্য সাহিত্য। জাক এ পর্যন্ত ২০টি নাটক মঞ্চায়ন করেছে। ২০০৫ সালে জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিলের ২৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে সর্বশেষ মঞ্চায়িত নাটক চিত্রা নদীর পারে। এভাব নাট্য চর্চার পাশাপাশি অন্যান্য মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে জুম ঈসথেটিক্‌স কাউন্সিল দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।


খাত্তাদক্কা
পরাগ রিছিল


খাত্তা শব্দের অর্থ কথা আর দক্কা শব্দের অর্থ বাজানো। মান্দি রীতি অনুসারে কোন অনুষ্ঠান শুরু হলে প্রথমে নাগ্‌ড়া (এক প্রকার ঢোল) বাজিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সে হিসেবে খাত্তাদক্কার অর্থ দাঁড়ায় আহবান । খাত্তাদক্কা কোথাও পরিচিত দিগ্গ্যি-বান্দি হিসেবে। ওয়াল্লা ওয়ালসন্‌নি সাল্লা সালসন্‌নি দিনরাতভর শুনলেও এই কাহিনী শেষ হবার নয়। মূলতঃ দিগ্গ্যি ও বান্দির বীরত্বগাঁথা বর্ণিত হয়েছে খাত্তাদক্কায়। ঘটনার ধারাবাহিকতা, পরিবেশ-পরিপার্শ্ব বর্ণনার সাথে এসে গেছে মান্দিদের অনেক সামাজিক নিয়ম-কানুন, জীবন-যাপন প্রণালী। যদিও তারা আমাদের মতো একেবারে স্বাভাবিক মানুষ নয় একই সাথে মিদ্দিরাং-মান্দিরাং দেবত্বপ্রাপ্ত। খাত্তাদক্কায় বান্দিকে জামাই দেখতে যাওয়ার জন্য সংশ্লি­ষ্টজনদের আহবান জানানো হয়। আমন্ত্রণ দাতা কখনোবা তৃতীয় ব্যক্তি, মাঝে মাঝে অন্তর্ভুক্ত চরিত্রগুলো কথা বলে ওঠে বা আমন্ত্রণ জানায় এবং নিজের ও অন্যান্যদের কর্তব্য নির্দেশ করে। দিগ্গ্যি ও বান্দি দুভাই-সিম্মিজিং, থিংকিজিং তাদের বোন। অপরদিকে খানজিং (সুরি) ও গিদ্দিং দু'বোন। বান্দিদের মামার মেয়ে। মান্দি সমাজের নিয়মানুযায়ী মামাতো বোনের সাথে বিয়ে হয় এবং মামাতো বোন/ভাইয়ের সাথে বিয়ের দাবিই থাকে সামাজিকভাবে প্রথম ও প্রধান। বান্দির মামা সাংমার্‌চ্চা (সাংমারাচ্চা)। তিনি বান্দির ছোটবেলায়ই তার বড় মেয়ে সুরির জন্য বান্দিকে জামাই নিবেন বলে বোন (বান্দির মা), আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে আসেন। বন্ধন তৈরী করে আসেন। তারপর তিনি আর সেদিক যাননি। মেয়েরা বড় হলে-বিবাহযোগ্য হলে; তিনি জামাই দেখতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সে মতো প্রস্তুতি নেন। তবে দিগ্গ্যি ও বান্দি দুভাই বীর এবং সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের পুত্র বলে...স্বয়ং মামাও (সুরির বাবা) তাদের ব্যাপারে চিন্তামুক্ত বা আশঙ্কামুক্ত নন। তাই গ্রামবাসী সবাইকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেন। জামাই দেখতে-ধরতে যাওয়ার দলে অভিজ্ঞ, শক্তিশালীদের ভারী করেন। তার আরেকটি কারণ হলো বরযাত্রীদের দলে অনেক যুবতীরাও রয়েছেন; তবে গ্রামের সব যুবককে সাথে নেননি। নির্দিষ্ট সংখ্যক শক্তিশালী যুবকদের গ্রামে রেখে গিয়েছেন। কেননা সেই সুযোগে গ্রাম শত্রুপক্ষের দ্বারা আক্রমণের শিকার হলে তারা যাতে প্রতিরোধ করতে পারেন।

ওদিকে...তাদের আসার কথা শুনে বান্দির দল প্রস্তুতি নিতে থাকে। মহিলারা কলাপাতা ছিঁড়তে-লাকড়ি সংগ্রহ করতে যায়। রান্নাবান্না করতে থাকে। বান্দি ঘরের রাস্তা সোনা দিয়ে লেপন করে রাখে! যেখানে এসে দাঁড়াবে, সেইসব স্থান। উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়!! সামনে যারা ছিল তারা বোকা বনে দেখতে থাকে। বরযাত্রীরা কত জন এসেছে গুণে দেখতে বলে। কি এনেছে কি আনেনি, কোনোকিছু আনতে বাদ পড়েছে কিনা সেসব দেখতে বলে। যা যা এনেছে সেসব তাদের জন্যেও নিয়ে যেতে হবে। সাংমার্‌চ্চা (সাংমারাচ্চা) দুই মেয়েকেই সাথে নিয়ে এসেছে। বান্দি মনে মনে ঠিক করে সে গিদ্দিংকে বিয়ে করবে। সুরিতো তার দাদা দিগ্গ্যির! এদিকে দিগ্গ্যি কুনো ব্যাঙের ছাল দিয়ে পোষাক বানিয়ে পড়ে। যাতে কেউ তার কাছে না ঘেঁষে-তাকে পছন্দ না করে। আলাপ-আলোচনা শেষ হয়। বান্দি বলে, জোড়াজুরি করলে সে যাবে না। তাকে জোড় করতে হবে না-ধরতে হবে না। সে তার মামাকে দেখাশুনা করতে জামাই যাবে। বিয়ে করবে গিদ্দিংকে। সূর্যের কপাট বন্ধ হয়ে আসে। চারপাশে আঁধার নামতে থাকে। সাংমার্‌চ্চার(সাংমারাচ্চার) দল খাওয়ানো শেষ হলে যেসব বড় পাত্রে চু-খাবার দাবার নিয়ে এসেছিল সেসব নিয়ে ফেরার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দিগ্গ্যি ছোটভাই বান্দি-কে বোঝায় যেন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি-সম্বন্ধিদের সাথে ঝগড়াঝাটি না করে। গ্রামবাসীদের সাথে ভালো আচরণ করে। বিদায় পর্ব চলে। মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব এতদিনকার পরিচিত প্রতিবেশ রেখে চলে যাবে-। বান্দি ঘরের খুঁটি ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। কেউ তাকে টানতে পারে না-নাড়াচাড়া করাতে পারে না-বোঝাতে পারে না। ...অবশেষে বরযাত্রীরা বান্দিকে সাথে নিয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরতে থাকে।

শিল্পরীতির দিক দিয়ে খাত্তাদক্কা বর্ণনামূলক। এর রয়েছে নিজস্ব সুর। মাঝেমধ্যে অবশ্য এক-দুটি সংলাপও রয়েছে।

বান্দিকে জামাই দেখতে যাওয়ার সময় যে ওয়াক (শূকর) কাটা হয়েছিল তার আকৃতি ছিল পর্বত সমান। দৃষ্টি সীমায় রাখা যাচ্ছিল না। তার পিঠের উপর গজিয়েছিল ঘাস আর সাতটি বাঁশঝাড়! দাঁতগুলো এত বয়সী, বড় হয়ে গিয়েছিল যে মুখের ভেতর আর কোন জায়গা অবশিষ্ট ছিলনা। বান্দির হাত ধরলে একটি শক্ত লোহার খুঁটি ধরার মতো অনুভূত হতো।

উপস্থাপনে নানান ধরন আনতে মামা মাচ্ছুরুর সংলাপের পাশাপাশি সামান্য রসিকতাও রয়েছে। যেমন অতিথিদের আগমন উপলক্ষ্যে যখন রান্না-বান্না চলছিল তখন রসিকতা করে মামা মাচ্ছুরুকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, ওয়াকের (শূকরের) চোয়ালের একপাশ কোথায়? মিদ্দি-ই খেয়েছে, নাকি রান্না করতে করতে তুমিই খেয়ে ফেলেছ? আবার থলে­ংমা রতরেংমা যার কাঁধে মৌমাছি বাসা বেঁধেছে। মাথার চুলে ফিঙের বাসা! আবার ছড়িয়ে রাখা পা-কে, কেটে ফেলে রাখা গাছ ভেবে তাতে উঠে একজন পায়খানার কাজ সেরেছে এরকম মজার কিছু বিষয়াবলী...

স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় প্রবল সাংস্কৃতিক চাপের মুখে নীচে পড়ে যাওয়া বা আড়ালে সরিয়ে রাখা এসব সাহিত্যকর্ম। সে যা হোক অসাধারণ কিংবা খুব সাধারণ-ই। কোথাও এগুলোর আলোচনা, বাঁচিয়ে রাখার মতো নূন্যতম চেষ্টা নেই!

যার মুখ থেকে শুনেছি- খামাল কুনেন্দ্র চাম্বুগং ( ছিজং ফা)। তখনো ৪৭-র দেশভাগ হয়নি। জন্ম ১৯২৯ সালের দিকে। রিজার্ভে। বর্তমানে ভারতের অংশ। পরবর্তীতে জামাই হয়ে চলে আসেন বেতকুড়ি গ্রামে। তখন বর্ডার ও পি.ডব্লিঊ রাস্তার কাজ চলছিল। মান্দি জাতিসত্ত্বার আত্তং গোষ্ঠীর লোকজন নিয়োজিত ছিলেন রাস্তা তৈরীর কাজে। কাজ শেষে প্রতিরাতে আগুন জ্বালিয়ে চারপাশ ঘিরে বসে জমিয়ে তুলতেন খাত্তাদক্কার আসর। ছিজং ফা ঘর ছেড়ে চলে যেতেন সে পালা শোনার জন্য। তখন বয়স পনের কী ষোল। শুনে শুনে সে সময়েই মনে গেঁথে রেখেছিলেন-আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন খাত্তাদক্কা। অনুবাদের কারণে হয়তো খাত্তাদক্কার প্রকৃত রস অনেকটাই হারিয়ে যাবে। খাত্তাদক্কার সিকিভাগ এখানে ছাপানো হলো।


হঅ...হ...অ...দা.আসালদে ম
আজকে
সা দাবো...দিগি য়্যা
কে এইভাবে আছো
রা রা হাই রিবো রিবো
আসো চলো, চলো
হাবা হনা রিগ্ননক ম
জমি পরিস্কার করতে যাই
রা রা...রিবো ম
চলো...চলো...
হাবা গামনা রিনাজক
জমি তৈরী করতে যাই
থুয়া চাখাত রিমবো
সকলে ঘুম থেকে উঠো
ফান্থি মিন্থ্রা রাংবা...দাদং
যুবক-যুবতীরা থেকোনা
গাআ জা-খরাগ্‌ব্বাসা দংবো
যারা নুলো তারা থাকো
ম্‌খ্যা গানা গ্‌ব্বাসা র'বো
যারা অন্ধ তারা থাকো
নামগিবা বিজাংথিরাংদে রি'বো রিথকবো
যাদের স্বাস্থ্য ভালো তারা চলো সবাই
হাআ হুনা নাংগিন্নক
মাটি কাটতে হবে
বিলসি য়ারা রিবাইজক
বছর তো আসছে
খারি য়ারা সকবাইজক রা রা
বর্ষা তো আসছে...
মিল্লামখন রাচাজক বিয়াবা
মিল্লাম(যুদ্ধাস্ত্র) তুলে নিল সেও
মিল্লামখন দিবাজক দি’য়াবা
মিল্লামই এনেছে-হাতে তুলেছে।
হাই রিথোকবো, মিশালখবা মিয়াখবা চুফাবো
চলো পথের খাবার-দাবার বেঁধে নাও
হিসাল দলস্‌ননি খোদে দলবো...অ
কলা পাতায় যা বাঁধার বেঁধে নাও
খকখ্রেং-খোদে অলফাবো
খকখ্রেং২ বহন করে চলো
গিথ্‌থি আথ্‌থি রাংখো
দা-কাঁচি নাও
রুয়া বাসি রাংখো রা...রা...রারুমবো
আগাছা বাছতে যা যা লাগে, নাও
মিল্লামখোদে দাগুয়াল
মিল্লাম নিতে ভুলো না
আথ্‌থিখোদে দাগুয়াল
দা নিতে ভুলো না
হানথাংথাংনি জাকরুমমাখো খাগুয়া
হাতে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো বাঁধতে যা লাগে-
ববিল-গ্‌ন্নাল নিকনাবা দঙ্গা
শত্রুদের সাথে দেখা হতে পারে।
হাই রিথকবো...চাখাতবো চাখাতবো
চলো সবাই-উঠো, উঠো
মাইয়াখো চানচিয়া
কী ভাবো,
মাইয়াখো নিগাম্মা
কীসের দিকে তাকাচ্ছো ?
নিফ্‌ল্লিবা দঙ্গামা
পেছন ফিরে কী কেউ থাকে
নিফ্‌ল্লিবা রিয়ামা
পেছন ফিরে ফিরে কী যায় ?
হাই রিথকারিবো
চলো সবাই
সাল্লারামনি আংদিসা বিসংদে
সূর্যের পুত্র তারা...
সালজক্কননি ফিসা ইসংদে
সূর্যাস্তের পুত্র তারা...
দেল মিৎচি ব্‌ঙ্গাখো
পনের হাত প্রস্থের গাছ
দেন্ন-নারা দেনথুয়া, দাক্কা-বান্দিদে
এক কোপেই কাটা শেষ করে...বান্দি এরকম
বিলসানান চতদুয়া বিলসানান হংমানজা
একবারের জন্যেও হয়নি, এক কোপে শেষ,
মগ্গলা ইসংদে
পড়ে গেছে।
রান্নি মিংনা দংসুয়া মাচ্ছা বা
বাঘ গর্জন করছিলো
মাচ্ছা আরো-ফা চাখক ওয়াগকসুয়ে দংসুয়া ইসংদে
বড় বাঘও নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল...
বল-খো ওয়াখো দেন্নবা চাখাতজা
গাছ-বাঁশ কাটলেও উঠেনি
বল্লা গাআকদাফ্‌ফোবা ইজামজা মাচ্ছাবা
শরীরের উপর গাছ পড়লেও বাঘ হাই তোলেনি
দাও মাই দাকগ্‌ন্নক...থবান
থবান এখন কী করবে?
খাইম্‌ন্না রুয়াচা ফ্‌ত্তা স্খুখো
কুড়াল দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে-
রাঙ্গসা চ্রক দুয়াঙ্গা
একবার লাফিয়ে গেছে,
চিরিং নালসা বালাঙ্গা বিয়াবা, মাচ্ছাবা
একটি ঝর্ণা পেরিয়ে গেছে
মাচ্ছা ছিদল গাব্বা মান্দিয়ানি ফংরাক্কা রামরামদে হংজানে
একটি বড় বাঘের শক্তি কমতো নয়
রামরামদে হংজানে
কম নয়!
অ মামা মাচ্ছুরু
ও মামা মাচ্ছুরু৩
অ চাখাতবো...
ওঠো...
হা'বা গামনা রিয়ামা-রিজামা
জমি তৈরী করতে যাবে কী যাবে না ?
অ মামা মাচ্ছুরু খিমি য়ারা জলরুরু
মামা মাচ্ছুরু লম্বা লেজ ওয়ালা
আহা খক্কাসক,আ-হা(কথা)
বোকা খক্কাসক,আ-হ

দাআয়ারা মাইদাক্কি রগিন্নক
এখন কীভাবে নাচবে
সিম্মিজ্‌ঙ্গা ননোয়া দিগ্যি
বোন সিম্মিজিং ?
থিংকিজিংঙা নন-আ
ছোটবোন থিংকিজিং
রিয়ামা রিজামা
তুমি কী যাবে?
অ-সুরি
অ সুরি
রি'বো আনচিংবা
চলো আমরাও-
অ মামা মাচ্ছুরু খিমি য়ারা জলরুরু
মামা মাচ্ছুরু লম্বা লেজওয়ালা

খা-আঙ্গা খক্কাসক আঙ্গাবা রিগন্নক(কথা)
বোকা আমিও যাব সাথে


রি'বো, রি'বো, রি'বো চাখাতবো
চলো, চলো, ওঠো...
অ বুদা র্‌ৎচ্চারা (বুদারাচ্চা)
বুদা র্‌ৎচ্চারা
আই হিগেন রিগ্‌ন্নক
যাবো চলো
সাল্লারামনি আংদিচা
সূর্যের পুত্রের কাছে...
সালজক্কননি ফিসাচা
সূর্যাস্তের পুত্রের কাছে...
হাই রিনা নাঙ্গোদে
যেতে হলে
চাচ্চিখোবা গ'বোমো..
আত্মীয়দের কাছে (কথা) ছড়াও...
মিখআরা জ'বো ম
চাল ভাঁজো
মা দাক্কে নি’গ্‌ন্নক
কীভাবে দেখব?
বাদিগিবা সগ্‌গিন্নক
কীভাবে পৌঁছবো?
চাচ্চিচাবা রিনাদে নাঙ্গা
আত্মীয়দের কাছে যাওয়া প্রয়োজন
চাওয়ারিখোদে নিনাদে নাঙ্গা...
জামাই দেখাও প্রয়োজন...
গিদ্দিংনাসা খানজিংনাসা সিনাজক
গিদ্দিংর জন্য খানজিংর জন্য জিজ্ঞেস করব
খানজিং না-সা নিনাজক অ-বান্দি খো...
খানজিং-র জন্য দেখব, বান্দিকে...
চাওয়ারি নিনা নাংনাজক
জামাই দেখতে হবে
চাওয়ারিদে সিকনাজক
জামাই ধরব,
দা-সালদে ম...
আজকে...
অ মামা...আ নিয়াআমা নিজামা
মামা দেখবে কী দেখবেনা
নিক্কামা নিকজাআমা
পূর্বে দেখেছে কী দেখেনি (?)
হাই রি'য়ে নিনাজক
চলো যেয়ে দেখি,
আমা ইন্নে চিঙ্গি চন্ন চন্ননি গান্না গানগিজাওনি
আমাদের ছোটবেলায়
চুয়া সংগুবাআন দঙ্গা
রান্না করা চু ৪ আছে
ইখো চেক্কে রন্‌বোনে চাচ্চি রিবাওদে
মেহমান এলে
ইখো সি'ম্মে রিংবোনে,ইখো
পানি মিশিয়ে দিয়ো।
আমা নাঙ্গো রিবাগেন
মা তোমার এখানে আসবেন
দাআসালদে নিকসুয়া জুমাংচা
স্বপ্নে আজ তাকে আসতে দেখেছি
মামা সকবায়েঙ্গা
মামা পৌঁছবে
মানি রিবায়েঙ্গা
মামীও আসছে
আফ্‌ফা নক্ক দঙ্গামা, দংজামা
বাবা ঘরে আছে কী নেই ?
বিখো সান্দি বাআঙ্গা
তার খুঁজে আসছে
বিখো নেম বাআঙ্গা
তাকে খোঁজ করছে

অ...থবান, থবান
ও থবান, থবান
হাই রিগিনকমো, হাই জকগ্‌ন্নকমো
চলো যাবে নাকি, ছুটবে কী-না
নাঙ্গি আনোয়ানা
তোমার বোনের জন্য
চাওয়ারিখো নিনামুং
জামাই দেখব
দে ফান্থিখো সিকনা ম
পুত্রকে (!) ধরি,কী বলো (?)
হাই রি-বো হাই রি'বো
চলো যাই, চলো
সাংমা রাচ্চা, হাই রিবোদা
সাংমা রাচ্চা যাই চলো
নাঙ্গি আনোনা
তোমার ছোটবোনের জন্য
দেফান্থি রানা...
পুত্র নেওয়ার জন্য...
চাওয়ারিখো সিক্‌না
জামাই ধরার জন্যে
হাই রি'বো, থবানারা থদিক্কা
চলো যাই থবান দ্বিধা করোনা।
সাংমাআরা র্‌চ্চারা
সাংমার্‌চ্চা
ও বুদা র্‌চ্চা, ও বুদা র্‌চ্চা
বুদা র্‌চ্চা
হাই রিবো নাবা, হাই রিবো নাবা
তুমিও চলো - তুমিও
আইয়াও...সা ইন্নে রিজাওয়া
আশ্চর্য... কে বলে যাবেনা (?)
সা ইন্নে সকজাওয়া...
কে বলে পৌঁছবেনা।
আঙ্গা রিনা নাংগিন্নক
-আমার যেতে হবে
আঙ্গা সকনা নাংগন্নক
আমার পৌঁছতে হবে
হাংথাংনি আনোনা
নিজের ছোটবোনের জন্য
হাংথাংআনি নামচিকনা
নিজেদের পুত্রবধুর জন্য
আঙ্গা রিজা জ্‌গ্গদে সা-রিজগ্‌ন্নকনো
আমি না গেলে কে যাবে
ফাংনা মুড়ি দংজামা
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কী নেই?
দংআবা দংজাওবা
থাকলে-না থাকলেও
আঙ্গা রিনা নাংগিন্নক
আমার যেতে হবে-
আঙ্গাবা জকগিন্নক
আমি মুক্ত হবো (দায়িত্ব থেকে)
বাই সাকসা নাংগ্‌ন্নক
কতজন লাগবে
বাই সাকসা রিগ্‌ন্নক
কতজন যাবে ?
রা রা ...রিবুদা ...
চলো
রা রা ...রিবুদা অ...
চলো
হাই চাখাত চাখাত
ওঠো,ওঠো...
সাল্লারামচা রিনামো
সূর্যোদয়ের দিকে যাবো
সালচখ্‌নচা জকনামো
সূর্যাস্তের দিকে রওনা দেবো
ইয়া ইন্নে...
এ-ই বলে।

খক্করিংখো অলবো
খক৫ ঝুলিয়ে নাও
মিগারিংখো জবো
পথের নাস্তা ভেঁজে নাও
হাই রিথোকবোমো
চলো সবাই
হাই রিবোমো
চলো যাই।
আমা নকচা রিগেনমো
মায়ের বাড়ি যাবে নাকি,
আম্বি নকচা সকনামো
নানীর বাড়ি পৌঁছাবে কী ?
হাই আনচিং-দে
চলো আমরা...।
বান্দি নক্ক দঙ্গোদে
বান্দি যদি ঘরে থাকে
সিকজল্লিবা রাবাগেন
ধরে নিয়ে আসব।
থল্লেবা রাবাগেন
মিথ্যে বলে হলেও
আমা নক্ক দঙ্গোদে
মা ঘরে থাকলে
বনিং দংআ দংসিলদে
প্রতিবেশীরা থাকলে
আদি নক্ক দঙ্গোদে
মাসি ঘরে থাকলে,
সিংজল হামজল দাগ্‌ন্নক
জিজ্ঞেস করব-তাৎক্ষণিক চাইব
রাবা জল্লে রিনগ্‌ন্নক
সাথে নিয়ে আসব
চুয়া মিয়া নাঙ্গোবা
চু ও ভাতের প্রয়োজন দেখা দিলে
ওয়াক্কা দুয়া নাঙ্গোবা...
ওয়াক৬, অন্যান্য প্রাণী লাগলেও...
জামানোসা রিনগিন্নক
পরবর্তীতে যাব সেসব বিষয়ে-
জামানোসা সিংগিন্নক
পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করতে।
দাআওনিনা আইয়োদে
এখন দেখব!
কথ্‌থা মেল্লিয়াঙ্গোদে
কথা যদি মিলে যায়-
খুফা মাগাপাঙ্গোদে
কথা যদি মানিয়ে যায়,
সিকজল্লারি রাগ্‌ন্নক
সাথে নিয়ে নেব
রিমজল্লারি নিগ্‌ন্নক
ধরে দেখব!
নিসকখবা দাদন
কোন কথা-ই শোনোনা
হাই রিম্মি রিবো..মো
চলো নিয়ে চলো...
হাই সাল্লি রি'বো মো
চলো টেনে নিয়ে যাই।

আঙ্গাআদে নিকখুজা ইন্নাবা দঙ্গা
আমিতো দেখিনি, বলতে পারে
মিচিকখোসা নিগ্‌ন্নক
মেয়েকে দেখব-
মিয়াখোসা সংগিন্নক ইন্নাবা দঙ্গা
ছেলেদের স্থাপন করবো (যেহেতু); বলতে পারে।
আঙ্গা রিম্মি রিগ্‌ন্নক
আমি নিয়ে যাবো,
আঙ্গা বুদা র্‌চ্চারা
আমি বুদা র্‌চ্চারা-
আঙ্গা সাংমা র্‌চ্চারা
আমি সাংমা র্‌চ্চারা-
হাই রি'বো মো
চলো যাই..।
ননোখোবা রিমফাবো
ছোটবোনকেও সাথে নাও,
আবিখোসা সালফাবো...
দিদিকে সাথে টানো
দিমদাগ্‌ন রিবো মো
সবাই চলো না-কি...?
আদা মামা দংগুবা দিম্‌দাকন রিনাদে নাংগ্‌ন্নক
ভাই-মামা যারা আছে সবারই যেতে হবে
সাল্‌নাদে নাংগ্‌ন্নক
টানতে তো হবে...
রামরাম অংফাগিজাসা বিসংদে
সাধারণ নয় তারা
গ্র বিহি গিমফালগুয়াসা খুফা আগানগুয়াসা ইসংদে
গ্র৭ খেতে তারা পারদর্শী
বিলরাক্কাবা রামরামদে হংজা বিসংদে
শৌর্যের দিক দিয়েও তারা কম নয়
মি'ল্লামচা রিম্মবা
মিল্লাম হাতে ধরলে
মিল্লাম রিংরাং রিংরাং
মিল্লাম চিক্‌চিক্‌ !!!
দাক্কারিসা দঙ্গানে বিসংদে
এভাবে থাকে তারা
বেল মিৎচিবঙ্গা বলখোদে
পনের হাত প্রস্থের গাছ
সাদন্নারা সাদ্দুয়া দাকনাআ মান্নানে বান্দিদে
এক কোপ-এক ছাঁট-ই যথেষ্ট বান্দির !
বিনি জাক্কো রিমরাদে
সে যেটি ব্যবহার করে
রামরাম হংফাগিজানে
সেটি আর সাধারণ নয়।
রামরাম থালহংগিজা
তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী-
বিখো সিক্‌না রিমগিপা ফাআমা-ফাজামা
তাকে ধরার সাহস হবে তো ?
হানগিয়া মা হানগিজা
কাছে ঘেঁষার সাহস কী হবে ?
বিখো রিমনা মান্নামা মানজামা
তাকে ধরতে পারে কী-না (?)
বিনি খুয়া আগানো
সে কথা বললে
জাজাআরি রগিন্নক
দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে নাচবে
খু-ফা বললাঙ্গো
অবিরাম বলে গেলে-
জ্রিম-হঙ্গি দংগিন্নক আনচিংদে
আমরা তবদা লেগে থাকব !
সা ইখো বলগেন
কে এটি বলবে?
সা ইখো থতগেন
কে এটি টোকা দেবে ?
সা ইখো মিংনুয়া
কে এর নাম উচ্চারণ করবে
সা ইখো দিনুয়া
কে এটি তুলবে;
ইখো মালমোকাঙ্গোদে
এটির সমাধা দিয়ে গেলে
বিসংনা বাত্তে গ্রখো জিনো
তাদের চেয়ে বেশী উপটৌকন দেবো
মা'নগুবাসা রিবোমো
যে পারো সে চলো,
খুফা আগানাংনা মানগিপা
যে ভালো কথা বলতে পারে
সা সকবো মো
সে পৌঁছ।

হেই দানাং মো, রা রা...
ওহ্‌ তোমরা...
ও বান্দি, চাখা চাখাত..চাখাত...
বান্দি ওঠো, ওঠো
হাই আনচিংবা রিনাজক
চলো আমরাও যাই
হাই রিগ্‌ন্নকমো থবানআরা থদ্দ্‌ক্কা...
চলো থবান
বানবানিসা দিগ্গ্যিয়া
দিগ্গ্যি, বানবানি৮ এখানে-।
হাই রিগ্‌ন্নকমো
চলো যাবে নাকি
হা'বাচিন রিনাজক
জমির দিকেই যাই।
ফান্থি-মিন্থ্রা রাংবা রিথকবো
যুবক-যুবতীরাও চলো
ম্‌ক্কাগানাগ্‌ব্বাসা দংরিকবো
অন্ধ যারা তোমরা থেকে যাও
জাআখরাকরাসা দংরিকবো
নুলো যারা তারা থেকে যাও
হাই রিগ্‌নকমো হাংথাংথাংনি গিচ্চিখো
চলো নিজেদের কপালের কাছে
হাংথাংথাংনি রুয়াখো
নিজেদের বপন
রাথকিন রিবোমো...
নিয়ে চলো...
বিলসি আ সকজক, খারিআ নক্‌জক দামাংমো
বছর এসেছে, বর্ষা বাড়ি পৌঁছেছে
ও মামা মাচ্ছুরু রিয়ামা রিজামা চাখাতবো...
মামা মাচ্ছুরু যাবে কী যাবে না, ওঠো

খক্কাসক আঙ্গাবা রিগেনথক (কথা)
বোকা আমিও চলে যাব

হাই রিবো-রিবো, হাই রিবো...
চলো যাই, তবে
না'ঙ্গি রিগ্‌বাখোদে সাল্লাসালজাংচিবানুয়া
তোমার সাথে গেলে দুপুর গড়াবে
ওয়াল্লা ওয়াস্‌ননিনা নিগন্নক
রাত্রি গড়াবে
ওয়াল্লা সালসিন্‌নিনা জগ্‌গন্নক মো
সারা রাত্রির জন্যে কী যাবো ?
হেই রি'বো ও বান্দি, ও বান্দি
চলো বান্দি, ও বান্দি
না'ঙ্গি জজংরাংখো না'ঙ্গি মামা রাংখো
তোমাদের ছোটভাই, মামাদের
না'ঙ্গি আদা রাংখোবা হা-ই থম্মি রি'বোমো
তোমাদের বড় ভাইদেরও নিয়ে চলো
হাই থাম্মি রিবোমো
চলো-জড়ো করে
আকসানাদে দারিবো
একা যেও না।
ববিলগ্‌ল্লাল দংনাবা দঙ্গা
শত্রু থাকতেও পারে
মিল্লাম স্ফি রাংখো দাগুয়াল
মিল্লাম স্ফি৯ নিতে ভুলো না
হানথাং জাকরুমরাংখোদে দাগুয়াল
নিজ হাতে ব্যবহৃত হাতিয়ার গুলো নিতে ভুলো না
জাল জি জি নি
নিজেদের -প্রত্যেকের
ফাখ্রংঅসা গাত্তিসা রিবো
কাঁধে উঠিয়ে নাও-
দাআ গুয়াল্লাবোনে
ভুলে যেও না যেন।
নাম্মা মিথ্রারাংবা...
সুন্দরী যুবতীরা
গিদ্দিং
গিদ্দিং
ও খানজিংরাং রিবো
খানজিং- চলো।
জাওয়া মান্দি মিকনেংনাবা দঙ্গা
অন্য মানুষ ঈর্ষা করতে পারে-
জাওয়া মাদ্দু নাবা দঙ্গা
অন্যেরা লোভ করতে পারে
দাজামান চাক্কাবো
পেছনে পড়ে যেও না
দাজামান চিক্কাবো
পেছন কামড়ে থেকো না,
নি-বা মিকবকগ্‌ব্বাবা দঙ্গা
দেখে পছন্দ করে ফেলার মানুষও রয়েছে
নিনা নাসিগ্‌ব্বাবা দঙ্গা
দেখলে ক্ষতি হয়ে যাবে- এমন রয়েছো যে-

হেই রিম্মআ অ-বুদা র্‌চ্চা মো
ডাকার সময়-বুদার্‌চ্চা,
অ সাংমা র্‌চ্চা মো
সাংমার্‌চ্চা
হাই আনচিংবা রিনাজক
আমরাও যাত্রা শুরু করি
আনচিংনি আমা আনোচা
আমাদের মা-বোনের কাছে,
চাওয়ারিনা রি'গেনমো
জামাইয়ের জন্য যাবে নাকি
দেফান্থিনা সিকনামো
পুত্রের জন্য ধরি (?)
আনচিংআনি আমাচা
আমাদের মা...
অ-মানি সারিচা...রিনামো রা...
শ্বাশুড়ি-ননদের কাছে যাবে নাকি...
থম্মেদাক্কে নিবো মো
যোগাড় করে দেখো-
মিয়া চুফাই নিবো মো
ভাত-চু রান্না করো
মিজারিংখো _Õ†¤^v মো
বাড়তি ভাতগুলো টোকাও
আনচিংবা রিনাজক
আমরাও যাই।
গাল্লা দিগ্রি দকমিদ্দিং সুরিবা
অলংকার পড়া শুরু করেছে সুরি
সকমিয়াচিং সকমিদ্দিং সুরিবা
পুষ্ট হচ্ছে স্তন
চাওয়ারিদে সিকনাদে নাংগ্‌ন্নকমো
জামাই ধরাতো প্রয়োজন।
মামাগিব্বাদে জাফাক চাংচাং দাক্কংজক
তার মামা (শ্বশুড়) তো জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে
বা'র্‌ক্‌নি সাল্লোদে
হয়তো কোনদিন
গ্‌ম্মা দঙ্গা নাসিনাবা দঙ্গা
হারিয়ে-বিনাশ হয়ে যেতে পারে
ইনা সিখাংইন সুষমরাখো সংনা নাঙ্গামো---
এর আগেই সুষমরা১০গাঁড়া প্রয়োজন নাকি?
নকরুমাখো সিকনা নাঙ্গামো--
ঘরজামাই ধরা প্রয়োজন।
হানথাঙ্গানি খামদাক্‌খো...
নিজেদের আপন মানুষকে
হানথাঙ্গানি খ্রিখো
ভালোবাসার মানুষকে
হাই নিনা রিনাজক
দেখতে যাই চলো।
রা রা ...হানথাঙ্গানি মসা বনিং দাক্কা রাংখো
নিজেদের শালা-সম্বন্ধি সম্পর্কীয়দের
রা থম্মি নি'বোমো
দেখো-জড়ো করে
চাখাত্তামা চাখাতজা
ওঠে কী ওঠেনা,
ইজাম্মামা ইজামজা
হাই তোলে কী তোলেনা
চামি সা-ই নিবো মো
ঘুম থেকে ডেকে
থকদিংখয়ে নিবো মো
চাপড় মেরে দেখো।
সাংমা র্‌চ্চারা হাইয়ামা হা-ইজা
সাংমার্‌চ্চা জানো কী ?
মান্দে থম্মে নিনাবা
মানুষ জড়ো করে দেখতে-
মান্দি ওয়াত্তি নিনাবা
মানুষ ছেড়ে দিতে
সেংগিপ্পা দাক্‌গিপ্পাখো
চালাক-চতুরদের
ফংরাকগিব্বা মান্দিখো
যারা শক্তিশালী।
ফান্থিরাংখো... থম্‌বো
-যুবকদের জড়ো করো
চাফাল মান্দিখোন নি'বো
বাড়ন্ত মানুষদেরই দেখো।

হানথাং বলজাওবা খুফা নাম্মি আগান্না মানগিপ্পা নাঙ্গা
নিজে বলতে না পারলে বাকপটু মানুষ প্রয়োজন
গ্রুজিনা মানগিপা নাঙ্গা
ক্ষতিপূরণ অস্বীকার করার মানুষ প্রয়োজন
খিন্নি খাসি বিবাল বালগিপা মান্দিবা নাঙ্গা
চুল পাকা অভিজ্ঞ মানুষ থাকলে-
উখো-ইন রিমনাদে নাঙ্গা
তাকেই ধরা প্রয়োজন।
ও বুদার্‌চ্চা
অ বুদার্‌চ্চা
দঙ্গাআমা দংজা
আছো কী নেই
নিক্কা দঙ্গামা দংজা
পূর্বে দেখা আছে কী ?
ও চাখাতখুজামা ও ইজামখুজামা
ওঠোনি কী ? হাই কী তোলনি ?
হেংগক রা-ই থুয়েঙ্গা, চামি সাও হাইজা
নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, উঠালেও টের পায় না!
সিলথংখোসা সু'য়েমুং গিংচা জতর্‌র্‌য়েতা
লোহা নাক দিয়ে ঢুকিয়ে-নাড়ানো হয়েছে
উনসা ইজামা ও বুদার্‌চ্চাবা
তখন হাই তোলেছে বুদার্‌চ্চা
বিনিবিল্‌বা রামরামারি হংজানে
তার শক্তিও কম কিন্তু নয়!
ও দ'রেং রাজা
ও চিল রাজ!
নাআ রিয়ামা রিজামা
তুমি যাবে কী যাবে না।
গিদ্দিংমা গিদ্দিং আনি ফাগিপা
গিদ্দিং এর পিতামাতা
চাওয়ারিনা রিনা হাম্মেঙ্গা
জামাইয়ের জন্য যেতে চাচ্ছি,
খিন্নামা খিন্নাজা
শুনেছ কী শোননি ?
নাআ হা-ইমা হা-ইজা
তুমি জানো কী (?)
হাই রিবো মো
চলো যাই...
রি'নাদে নাংচংমত্তা
যাওয়াতো অবশ্যই প্রয়োজন
সা ইন্নে রিজাওয়া
কে বলে যাব না ?
হানথাংনি আমানা হানথাংনি নামচিকনা
নিজের মায়ের জন্য-পুত্রবধুর জন্য
হানচিং সান্দিজাওদে সা সান্দিনুয়া
আমরা না খুঁজলে কে খুঁজবে ?
সা ইনজামনুয়া
কে হাই তোলবে।
অ... দাআসালদে মো
আজকে অন্তত
অ স্খাল লাল্লেং খো নিয়ে চাখাত
রাক্ষস লাল্লেং-কে দেখে উঠো !
হাইয়ামা হাইজা
জানো কী জানোনা
গিদ্দিংনি ফা গিম্মা
গিদ্দিং বাবা হারিয়েছে।
জামাইনা রিনা হা'মেঙ্গা
জামাইয়ের জন্য যেতে চাচ্ছি-
রি'না নাংগেন মো আনচিংবা
তো যাওয়া কী দরকার আমাদের?
আঙ্গা ইজামখুজামুং
তখনো হাই তুলিনি
আঙ্গা স্মাক খুজামুং
আমি তখনো জাগিনি
আগানাবা দংজা বলাবা দংজা
বলা নেই কওয়া নেই,
বাদিক-কিবা হা-ইনা
কীভাবে যে জানবো,
বাদ্দিকিবা বল না
কীভাবে কথা বলব ?
হুম...ম...ম...
হুম...ম...ম...

হাই রিগ্‌নকমো হাই রিগ্‌নকমো
যাবে নাকি চলো, যাবে নাকি?
সা সা রিগ্‌নক সা সা দগিন্নক
কে কে যাবে, কে উজান বাইবে?
হানথাং-থাঙ্গন চানচিয়ে রারুমবো
নিজেরাই ভেবে নাও
চাওয়ারিখো সিংনাদে নাংজক গিদ্দিংনা
গিদ্দিং এর জন্য জামাই দেখা প্রয়োজন,
দে ফান্থিখো সিঙ্গনা নাংগ্‌নক
পুত্রকে জিজ্ঞেস করতে হবে
হাই রিরুমবো মো
চলো সকলে।
আমা ইন্নে গিদ্দিংনে
মা বলে গিদ্দিং
গান্না গান্‌জা দান্নোনে,চুয়া সংগিবা দঙ্গা
তোমার ছোটকালে রাঁধা চু আছে
ইখো রা-ই হিবোমো
এটি নিয়ে চলো
আক্‌খিসা ইন্নোবা
সামান্য হলেও,
গ্রকসাদে থিকনুয়া
এক ঢোক করে হবে,
গ্রকসাদে থিকনুয়া
এক ঢোক করে হবে।
সা সা রিব্বিগেন
কে,কে বহন করবে
সা সা অলগেন
কে কাঁধে তুলবে ?
খাকসি বিড়িগদ্দা
বদনার...
সাকবিঙাদে নাপনা মান্না খাক্ষীবা
পাঁচজন নল দিয়েই ঢুকতে পারে
চিলমংগিদ্দা খলগ্রিক গ্রি নাপ্‌পা
বিশজন মুখ দিয়ে।
হিখো সুগাল্লে রাবোমো
এটি ধুঁয়ে নাও-
বান্দিয়ানা খান্নাদে নাঙ্গা ইনোমো
বান্দির জন্য খাওয়ানো প্রয়োজন
বিচ্চিখদে দিংদাঙ্গন রা'বো
রস আলাদা-ই নাও
গ্রানখদে দিং-দাঙ্গন থমবো
শুকনো (খাবার) গুলো আলাদা কুড়াও
দাআ গুয়াল্লাবোনে বিখো থুসিফেক্কেতে
ভুলনা, তাকে গাঢ় ঘুমে রেখে,
বিখো b‡¤^v‡MZ-wMRv‡b
দুর্বল না করে
আনচিং সিঙ্গনা মানজাওয়া
আমরা জিজ্ঞেস করতে পারবো না-
বিয়াদে রামরাম হংফাগিজাসা
সে কিন্তু সাধারণ নয়
রামরাম হংফাগিজাসা বিয়াদে
সাধারণ নয় সে -।
গ্র জিয়বা-বিয়াসারা হংজানে
গ্র তাকে ছাড়া হয়না
সাল্লারামনি আংদিসা বিসংদে
সূর্যের সন্তান তারা...
আনচিংঙ্গাদে মাইবা?
আমরা কে?
থাম্‌ফি মাংসিনিগিদ্দা হংজা , আনচিংদে
একটি মাছির মতো নই
খু’ফা বলনা গিত্তাবা হংজা নাচিংদে
কথা বলার মতোও নই।
বিনি জাকথংখো রিম্মআ সিলথংখো রিম্মাগিদ্দা দাক্কানে
তার হাতের কব্জি ধরলে লোহার খুঁটি ধরার মতন,
খিন্নিসক গা’গংনে, বিয়াদে
পা থেকে চুলের প্রান্ত পর্যন্ত
রামরাম হংফাজাসা....বিয়াদে
সাধারণ নয় সে......।
বেলমিক্‌চি ব্‌ঙ্গাখো
পাঁচজনকে
জা’গ্রা দামবেং র’ন্নানে
ঘরের রুয়া-বাগা বানাতে বলেছে।
ব্রেপ্‌দংদং বিয়াদে
দিয়েছে শক্ত বাঁধন।
ইখো নিক্কআরা না’সংদে
ঘর দেখলে
নাপনা হাসিকামা হাসিকজানুয়াই
ঢুকতে কী ইচ্ছে করবে ?
আঙ্গাআন চন্নো বিখো নিকগিবা ইন্নে
আমি ছোটকালে যেহেতু তাকে দেখেছি
বিখো খুদ্‌ম্মে নিয়ন মিক্রন রংদাল্লেসা নিয়ানে বান্দিদে
তাকে চুমু দিয়ে দেখলে চোখ বড় বড় করে তাকাতো বান্দি!
মামা গিপ্পাআন খেনসিক-খেনসিক দাকফিল্লে
আপন মামা ভয়ে ভয়ে
খুফাখন আগান্নারিয়া
কথা শুরু করে-
বিখবা দেকেন...চাওয়ারিদে হাখাঙ্গে দন্নবা বিয়াবা
তাকে আগে থেকে জামাই ঠিক করে রাখলেও
আঙ্গি সুরিনান, বিখোদে
সুরির জন্যে।

খুমানসিয়ে দন্নাংজক
কথা বলে যাচ্ছি
খুমানসিয়ে দনবাজক
কথা বলে এসেছি
ওয়ালদুখায়ে দনবাআ বিনি আফ্‌ফারাংমুং
বাঁধন দিয়ে এসেছি তার অভিভাবকদের সাথে
বিনি গুমিরাংমুং
তার দুলাভাইদের সাথে
বিনি আদিমুং
তার মাসির সাথে
বিখো ইন্নো বিয়াবা
জিজ্ঞেস করলে সে নিজেও
বিসংবা খুরাচ্চাক্কা, মা-গিবাবা
প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাজি মা ¯^qs-
চিঙ্গা থাসি জিলনোমা,
আমরা কী খাসি বানিয়ে পালব ?
চিঙ্গা ব্রেপ জিলনোমা
আজীবন বন্ধন দিয়ে পালব ?
নাসংনান আংদিখো বাআবান
তোমাদের জন্যই পুত্র জন্ম দিয়েছি
নাসংনান চিঙ্গাদে চিয়াবা
তোমাদের জন্যই আমরা সন্তান প্রসব করেছি
নাসং রাজাজক্কদে সাওয়াবা রানুয়া
তোমরা না নিলে কে নিবে
সাওয়াবা রানুয়া ইন্নো
কে নেবে বলেছে?
নাসং নিজাজক্কদে
তোমরা না দেখলে-
নাসং দিমজাজক্কদে
তোমরা ভনভন না করলে
সাওয়াবা নিগ্‌ন্নক
কে দেখবে,
সাওয়াবা চাগিন্নক
কে খাবে?
অ মামা মাচ্ছুরু খিমি জলরুরু
ও মামা মাচ্ছুরু লম্বা লেজওয়ালা
অ নাঙ্গি য়্যা বাগ্নাখোদে
তোমার এই ভাগ্নেকে
দাআসালদেমো চাওয়ারিখো সিঙ্গনা রিবাওঙ্গা
আজকে জামাই জিজ্ঞেস করতে আসছে
খিন্নামা-খিন্নাজা
শুনেছ কী শোননি ?
খা গগ্গাসক আঙ্গাদে খিন্নাখুজানে,
বোকা আমি, শুনিনি
থাম্ফি মাংগিদ্দাবা আঙ্গাবা খিন্নাখুজা খা গগ্গাসক
একটি মাছির মতোও শুনিনি।

রা ইন্দাকোদে নিসুবো
এরকম.....হলে তাকাতে থাকো
হিবাগিপ্পা মান্দিনা হামফক হনসুনাদে নাংনুয়া
অতিথিদের জন্য পিঁড়ি দিতে হবে
জাল্লেঙ্গা,বিনি কাসারিখো বিনি বান্দাসিলখো
জায়গা বাড়িয়েছো...? কাচারি ঘর তৈরী করো
থারিয়েমুং দনসুবো হাথ্‌ল্লাখো নকখ্রাকো
পরিস্কার করে রাখো বাড়ির উঠোন-আশপাশ
চিরঙ্গেমুং সিকসুবো ও মামা মাচ্ছুরু অ খিমি জলরুরু
সুন্দর করে স্বাগতম জানাও মামা মাচ্ছুরু।
অ নাঙ্গি মান্দিরাংখোবা সা সা দঙ্গা
তোমার মানুষ কে কে আছে ?
দিসা ফিসারাংখো রাই রা...অ থম্মি সুবুদা
ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে...
রা......থারিসুবুদা
তৈরী করতে থাকো-
নাঙ্গি আবিরাংখো নাংনি আনুরাংখো
তোমার বড়-ছোট বোনদের
সংনি নক্‌নি মান্দিরাংখো জদিম্মি স'বো দে
গ্রামের মানুষদের সাথে নিয়ে
না-আ দকথুং খাবোনে
সর্বক্ষণ জাগ্রত রাখো
হিজুজুয়েসা আগানবো
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলো
হিরুরুয়েসা বলবো
হাঁটতে হাঁটতে কথা বলো
সংনি মান্দিরাংখোবা
গ্রামের মানুষদের
হানি মাচ্ছকরাংখোবা
মাটির হরিণদের
চিঙ্গা হু-ইফাজানে
আমরা চিনি না !
ইন্নিয়্যা চিঙ্গা হাইফাজানে আগাননুয়া
আমরা চিনি না বলবে কেউ-
খিন্না না গিদ্দা-হাইনা গিদ্দা
কথা শোনার জন্য-জানার জন্য।

য়্যা দফিসাখো নিবো
এই মুরগীর বাচ্চাটি দেখো-
য়্যা ওয়াকফি সাখো রিমবো
এই শূকরের বাচ্চাটি ধরো
মান্দি হিবা জগ্গদে
মানুষ এসে পড়লে
দাক্কামব্রুই ফিন্নিকাগিদ্দা ইননুয়া
দেখাচ্ছে-বলতে পারে
সা বিলরাকগুয়া সা
শক্তিশালী-কে?
ইখো রিমনা রিয়াংবো
সেটি ধরতে চলে যাও
গিদ্দিঙ্গানি মাগিপ্পা ইন্নে
গিদ্দিংর মা বলে
দিসা ফান্থি দ'ঙ্গো জিলগিপ্পা ওয়াকফিসা
যুবতী বয়সে পালা বাচ্চা শূকর...
ওয়া-গি চিনসিননি চাগিপ্পা ওয়াক্কা-নে
পিঠের উপর সাতটি বাঁশঝাড় উঠেছে
রিংখং চাংখেত ফিলজকনে খুসিকবা
দাঁতের জন্যই জায়গা আর নেই
জেংচেং চংস্‌নে চাগিপ্পা ওয়াক্কানে
লাল ঘাস উঠেছে দেহের উপর
নিয়আরা নিসকজা আব্রি চতসা গিত্তাসা নিকজকনে
তাকালে-সীমাহীন উঁচু পর্বতের মতো দেখাচ্ছে
রা ইখো রিমনা রিয়াঙ্গো-আ
সেটি ধরার জন্য গেলে-
নিক্কারিন ওয়াল-ফিল্লা মাচ্ছুরু
দেখেই ফিরে এসেছে মাচ্ছুরু
নিক্কারিন দিফিল্লা, বিয়াদে
তুলেছে লেজ।
আঙ্গাআদে....আঙ্গা আমসকজাওয়া, আঙ্গা ইখো
পারবোনা এটি, সাহস কুলোয় না
রিমনাবা মানজাওয়া,ইন্নানে
ধরতে পারবো না-বলেছে।
অ-বানবান-নে, রা রি'ম্মে নি'বোদা
বানবান ধরে দেখো
রা সিক্কি নিবোদা
আটকাও-
মান্দি রিবাজকদে দাক্কামব্রুই ফিন্নিকাগিদা হংনুয়া
মানুষজন এসে পড়লে দেখানোর মতো হবে
ইচা সকবাজগ্‌দে
এখানে পৌঁছলে-
ফিন্নিকেমুং রাআগিদ্দা
দেখিয়ে নেয়ার মতো হবে।
সঙি মিন্নি দান্নোদে দখ্রুখবা নিনা আলথুনুয়া
রান্না করে রাখলে ঘুঘুর মাংস ভালো দেখায়!
থারি আসিম্‌ন্না সঙি মিন্নি দন্নোদে দখ্রুখবা নিনা আলথুনুয়া
তৈরী করে রান্না করে রাখলে ঘুঘুর মাংসও !
রা রা...বানবানিয়া রিম্‌দি-রিম্‌না রিয়াংজক
বানবান সত্যি সত্যি ধরতে গেলো-
জম্‌ফি জম্‌ফি জম্মাংজক
নিঃশব্দ পায়ে, ধীরে ধীরে
ওয়াক্কা জাফাংচান সক্কাঙ্গো
শূকরের কাছে পৌঁছলে
রাংসা উক ইন্নানান মিকবঙ্গানাদে থিল্লাংজক বিয়াদে
একবারের উক শব্দেই পাঁচ হাত দূরে পড়ে গেলো
অ আঙ্গাদে মানজাওয়া, আঙ্গাদে, ইনাদে
আমি পারবো না, পারবো না এটি
আঙ্গা আমসক্‌জাওয়া, আঙ্গাদে
সাহস কুলোয় না আমার।

দাআওয়ান...অ মামা দিগ্গ্যিবা রিম্মামা-রিম্‌জামা,
এখন মামা দিগ্গ্যি ধরবে কী না,
সা আমসকনাজক
কে আর সাহস করবে?
বান্দি গ্রি মানজাওয়া ইখোদে
বান্দি ছাড়া কেউ পারবে না
বান্দি গ্রি রিমনাদে নিকজাওয়া
বান্দি ছাড়া ধরার মতো দেখি না কাউকে
সাকসাবা মানজাওয়া, ইখোদে
কেউ পারবেই না।
ও মামা...সাংমা র্‌চ্চারা
মামা, সাংমা র্‌চ্চারা
নাআ রিব্বি নিবুদা
তুমি বহন করে দেখো
নাঙ্গি বাগ্নানি মান্‌সিগিব্বা ওয়াকখো
তোমার ভাগ্নের মানসার শূকর
রা রিম্মি নিবুদা
ধরে দেখো
রা, সাল্লে নিবুদা
টেনে দেখোতো ?
রিয়াঙ্গেমুং রুম্ম-য়্যা
গিয়ে ধরলে-
ওয়াকনি গাথিং দাত্তানা মিকচিবঙ্গা থিলাঙ্গা, বিয়াদে
শূকরের লাথির জন্য পনের হাত দূরে পড়েছে
রিমরিম মিত্থাল দাক্কিজক, বিয়াদে
গড়াতে গড়াতে...
ওয়াখি-মিখ্‌খি দাক্কিসা দঙ্গিজক, বিয়াদে
লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে থাকলো।
অ বানবান...আরা...রিম্মি নিবুদা, নাবা
বানবান তুমিও ধরে দেখো
আঙ্গাদে মানজাওয়া নিক্কারিন আঙ্গাদে আমসকজা
আমি পারবো না , দেখেই সাহস করি না,
নিক্কারিন আঙ্গাদে নিসকজা
আমার দৃষ্টি সীমারই বাইরে
বান্দি হানথাং মাআম্মে রিয়াংজক
বান্দি নিজে শব্দ করে চলে গেলো
বায়ানা নাসঙ্গা
কোথায় তোমরা ??
রিস্‌ফিলখো খিজামা নাসঙ্গা বিলআরা দংজামা নাসঙ্গা
তোমাদের শরীরে কী শক্তি নেই, পুরুষলিঙ্গ কী বহন করোনি ?
ইখো মানজাওদে... আকথেত্তারি গাল্লেত, গাল্লেত
এটি না পারলে ছিঁড়ে ফেলে দাও, ফেলে দাও
ইনাআন খাদিঙ্গা মিন্থ্রা দিসা দংগিপ্‌আরাংদে
একথা শুনে উপস্থিত যুবতীরা হেসেছে
বান্দিয়ানি ইন্নানান, বান্দিয়ানি বলানান
বান্দির কথা বলার জন্য।
বিয়া হানথাং রিয়াঙ্গা জাকসামসাও রিম্মিমুং গুসিথাপ্পি রয়েঙ্গা, বান্দিদে
নিজে গিয়ে একহাতে ধরে আছাড় দিয়ে নাচছে বান্দি!
‘উক’ ইন্নেরুম্মআ, বিনি জাকসিখিলচান, বিয়াদে
উক শব্দ করে। নখ দিয়ে
রাসত্তিমুং নিজকনে, বিয়াদে
জবাই করে দেখলো সে
বান্দিদে. বিয়াদে
বান্দি......
উক উক ইন্নবা ওয়াতজাজক,
উক উক শব্দ করলেও ছাড়লো না,
জাথেং সামসা গাথাপ্পে জাকসিখিলচা থেতফ্রুজক, বিয়াদে
এক পা দিয়ে চেপে রাখলো,নখ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করলো
ইখো মাতচতিসা বিয়াদে
সেটি শেষ করে
দনবাজক সিয়েত্তেমুং দনবাজক
মৃত করে রেখে এসেছে।
ইখো সঙ্গনা রাং-বো, ইখো থারি রিমবো
রান্নার জন্য নিয়ে নাও, এটি তৈরী করো-
ইন্নেমুংনা বান্দিদে গবেংব্রাক্‌কি দনবাজক
বান্দি ছুঁড়ে রেখে এসেছে
য়্যা ওয়াকফিসাখোদে, বিয়াদে
ঐ শূকরের বাচ্চাটি


(অসমাপ্ত)
কৃতজ্ঞতাঃ
বন্ধুত্বের দাবি পেরিয়ে হয়তো কখনো যাকে বিরক্ত করেছি-বিপ্র চিসিম;
সুপার রাকসাম, প্রাণশন দালবৎ, সুহাস দফো।
আরো অনেকে...খাত্তাদক্কা শোনার সুবাদে আমরা যারা
মেতে উঠেছিলাম...!
মিলিত হয়েছিলাম...!



Friday, August 31, 2007

মৃত্তিকা বুলেটিন ক্রম: ০১; বর্ষ ক্রম:০২




মৃত্তিকা
জাতিতাত্ত্বিক লোকায়ত জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ
বর্ষক্রম:০২,বুলেটিন ক্রম:০১
বীর শহীদ পীরেন স্নালের মহান আত্মত্যাগের এক বছরে বিশেষ পত্র
প্রকাশকাল: ২০ পৌষ ১৪১১ বঙ্গাব্দ, ৩ জানুয়ারি ২০০৫ খৃষ্টাব্দ।।৩৪৭ শহীদ সালাম বরকত হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা থেকে প্রকাশিত।। বিনিময়: ২ টাকা
সম্পাদনা:জুয়েল বিন জহির, পরাগ রিছিল, দুপুর মিত্র; সহযোদ্ধা: শারমিন শর্মী, জাহানারা খাতুন সীমা, তাসলিমা আক্তার রোমন।

বীর শহীদ পীরেন স্নালের রক্ত বলে যায় নিরন্তর সংগ্রামের কথা



১.শালবন কোচ,বর্মণ, মান্দি জাতির হা.বিমা...

টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একসময় ছিল শালবনে আচ্ছাদিত মধুপুর গড় এলাকা। এই শালবনে হাজার হাজার বছর ধরে মান্দি, কোচ, বর্মণ প্রভৃতি জাতিসত্ত্বার লোকজন বসবাস করে আসছে। এই শালবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তাদের বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় জীবনাচার। শালবন মান্দি জাতির হা.বিমা। এই হা.বিমা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র। বলশাল ব্রিং এর নানান প্রজাতির গাছপালা-তরুলতা, পশুপাখি সব কিছুর সাথেই গড়ে উঠেছে তাদের অকৃত্রিম সখ্যতা। কেননা মান্দিরা বিশ্বাস করে যে, এই ব্রিং এর যত গাছ-পালা, পশু-পাখি সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে মিদ্দি বাগবা-র পবিত্র চিপাংফাক্‌ছা থেকে। একসময় শালবনের ভিতরে নিজস্ব রীতিতে হাবাহু.আ-র মাধ্যমে ঘরে তুলত নানান ফসলাদি। কোন অভাব অনটন তেমন ছিল না। শালবনে বিচরনের ক্ষেত্রে বা ফল-মূল সংগ্রহ বা হাবাহু.আ-র জন্য কারো কাছে কোন অনুমতির প্রয়োজন পড়ত না। কেউ একবার কোন জংলা জমি পরিস্কার করে যদি জুম আবাদ শুরু করত তাতেই ঐ জমির উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত। অন্য কেউ তখন আর ঐ জমির উপর নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনরূপ চেষ্টা করত না। এটাই ছিল সমাজের নিয়ম, যা বংশপরম্পরায় চলে আসছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কিন্তু এরপর একে একে পাল্টাতে থাকে শালবনের উপর আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারের ধরন-ধারন। ব্রিটিশ জমিদারি প্রথার মাধ্যমে মধুপুর গড় নাটোরের রাজার অধীনে আসে। নাটোরের রাজার শাসনাধীন হওয়ার পর মান্দিরা শালবনের নিচু জমি নিজেদের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিতে এবং উঁচু জমিতে লীজের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে পারতো। ১৮৭৮ সালে ধানী জমি ভারতীয় প্রজাসত্ত্ব আইনে নথিভুক্ত করা হয় যার আওতায় বছর বছর তারা নিয়মিত কর প্রদান করে থাকে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় নানান প্রকল্প-প্রক্রিয়ায় শালবনেরই সন্তান মান্দি, কোচ, বর্মণদের উচ্ছেদ করার নিত্য নতুন আয়োজন। আর এইসব আয়োজন-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মান্দি, কোচ, বর্মণেরা লড়ে গেছেন অসীম সাহসিকতায়। নিজ জননী ভূমিকে রক্ষার জন্য সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই রচনা করে চলেছিল একের পর এক প্রতিরোধের। আর এই প্রতিরোধ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ৩ জানুয়ারি গায়রা গ্রামে বহু যুগের নির্যাতন-নিপীড়নের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ তাদেরকে দাঁড় করিয়েছিলো ইকোপার্কের নামে হা.বিমাকে দেয়াল দিয়ে ঘেরার প্রতিবাদ জানাতে।খা সাংমা,খা মারাক-ধ্বনিতে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে, জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মান্দি, কোচ, বর্মণ জাতিসত্ত্বার লোকজন। নিজেদের অধিকার এবং নিজ হা.বিমার সম্মান কে অক্ষুণ্ন রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সমবেত হয়েছিল দেয়াল নির্মাণ রুখে দিতে। সেদিন হাজার হাজার আদিবাসীর বিপ্ল­বী চেতনাকে ম্ল­ান করে দিতে বনরক্ষী ও সরকারি পেটোয়া বাহিনী পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন পীরেন স্নাল; আহত হয়েছিলেন উৎপল নকরেক, এপিল সিমসাং, শ্যামল চিরান ও রীতা নকরেক সহ আরো অনেকেই। এই যে পীরেন স্নালের মৃত্যু বা আরো অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা, তা কোন ভাবেই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শালবনের আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ও শালবনকে ধ্বংস করার জন্য বন বিভাগ বা শাসক গোষ্ঠীর ধারাবাহিক অমানবিক, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের একটা অংশমাত্র।


২.শালবন ধ্বংস এবং আদিবাসী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নাম ফরেস্ট এ্যাক্ট, রিজার্ভ ফরেস্ট, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্প,তুঁত চাষ, ফায়ারিং রেঞ্জ...

যুগ যুগ ধরে শালবনে বসবাসরত কোচ, মান্দিদের কখনো বনের উপর মালিকানা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়েনি। অন্যভাবে বলা যায় যে, মালিকানা শব্দটির অর্থই ছিল তাদের কাছে অজ্ঞাত। যে শালবনে তাদের জন্ম, বেড়ে উঠা, বনকে ঘিরেই যাদের ধর্ম, আচার, সংস্কৃতি তার আবার মালিকানা কীসের। তারাতো বনের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন কাজ কখনো করেনি। বন থেকে যখন থারেং, থা.মান্দি সংগ্রহ করতো তখনতো তারা পুরো গাছটাকেই উপড়ে তুলে ফেলত না; বরং কাঙিখত আলু বা কচু সংগ্রহের পর সেই গাছটি আবার সযত্নে মাটিতে পুঁতে দিতো। বিভিন্ন আমুয়া(পূজো) বা অন্যান্য কাজে যখন ফুল-ফল, লতা-পাতার প্রয়োজন পড়তো তখনতো জঙ্গলের বা গাছের কাছে অনুমতি না নিয়ে তারা একটা জিনিসেও হাত দিতো না। তারাতো বন থেকে কোন জিনিস অবাধে লুটে-পুটে নিয়ে কখনো বাইরে পাচার করেনি। বরং বনের জীববৈচিত্র্য যাতে অক্ষুন্ন থাকে এজন্য মান্দিরা প্রতিবছর বর্ষাকালে পালন করতো আসংদেনা আমুয়া। আমুয়ার দিন খামালের (পুরোহিতের) পিছনে পিছনে সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করে একটা জায়গায় পূজোর কৃত্যাদি সম্পন্ন করার পর সেখানে সবাই মিলে রোপন করতো নতুন গাছের চারা। এভাবেই নানান নিজস্ব রীতি-নীতিতে তারা বনকে, বনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে আসছিল যুগ যুগ ধরে। বনকে ধ্বংস তো দুরে থাক, বনের সামান্যতম ক্ষতি করাকেও তারা মারাং বা দূষণীয় জ্ঞান করতো। এইছিলো শালবন কে ঘিরে কোচ, মান্দি, বর্মণদের ধ্যান-ধারনা বা বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের বিপরীতেই পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় সরকারের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে মধুপুর শালবনের উপর। ১৯৪৯ সালের `East Pakistan Private Forest Act’(Act of 1950) এবং ১৯৫০ সালের `East Pakistan State Acquisition and Tendency Act’ এর অধীনে ‘রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার মাধ্যমে শালবনকে দখল করা হয়। এরপর বনবিভাগ কর্তৃক শুরু হয় কোচ,মান্দি, বর্মণদের উপর একের পর এক উচ্ছেদ নোটিশ, জবরদখল, লুটপাট, মিথ্যামামলার নানাবিধ খড়গ।

ভারতীয় প্রজাসত্ত্ব আইন রদ এবং এই আইনের আওতাধীন আদিবাসীদের রেজিষ্ট্রিকৃত জমি বাজেয়াপ্ত করার প্রচেষ্টাসহ ১৯৫৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বন সেটেলমেন্ট অফিসার এস. এইচ. কোরেশী উচ্ছেদ নোটিশের ইশতেহার প্রকাশ করেন।

১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর আজম খান মধুপুর বনে ৪০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য ঘোষণা করে এবং এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রায় ২১ হাজার একর এলাকায় যেখানে হাজার হাজার মান্দিরা বসবাস করছে সেখানে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।

১৯৬৮ সালে গভর্ণর ও বনমন্ত্রী কোন রকম ক্ষতিপূরণের আশ্বাস ব্যতিরেকেই চুনিয়া গ্রামের মান্দিদের প্রথম উচ্ছেদ নোটিশ এবং ১৯৬৯ সালে জাতীয় উদ্যান প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চুনিয়া গ্রামে দ্বিতীয় উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে।

১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে শালবনের বাসিন্দারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র, লড়েছিল জীবন বাজি রেখে। শহীদ হয়েছিলেন অনেক আদিবাসী নারী-পুুরুষ। কিন্তু স্বাধীসতা সংগ্রামের পরেও শালবনের আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় আচরনের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। বনের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী আমলের সমস্ত কালাকানুনই থেকে যায় অপরিবর্তিত। ১৯২৭ সালের`The colonial Forest Act’ পাল্টায় না, চরিত্র বদল হয় না বনবিভাগের, বনমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রযন্ত্রের। মাঝে মাত্র তিনবছর বাদ দিয়ে ১৯৭৪ সাল থেকেই আবার পুরোদমে শুরু হয়ে যায় বনবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের রকমারি সব কৌশলাদির বহুমাত্রিক প্রয়োগ। মাঝে মধ্যেই নানান অজুহাতে ফলবাগান, ধানীজমি সবকিছুই তছনছ করে দিয়ে যেত বনকর্মকর্তাদের নেতৃত্বে বনরক্ষীরা। বনের অধিবাসীরা স্থানীয় থানায় মামলা করতে গেলেও সেই মামলা গ্রহণ করা হত না।

১৯৭৭ সালে বনবিভাগ কর্তৃক শালবনের ভিতর কৃত্রিম লেক তৈরির নামে কোচ-মান্দিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্পের আওতাধীন এলাকায় হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত অধিবাসীদের উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে। একই বছর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ভেড়া চড়ানোর নাম করে শালবন এলাকার চাপাইদ গ্রামে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে নেয়।

১৯৮১ সালে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বনকর্মকর্তার বিট অফিস প্রতিষ্ঠা ও তুঁত গাছ রোপনের নামে শালবনের মান্দিদের ১০৮ একর জমি দখল করে নেয় বনবিভাগ। আর এই দখল কার্যের জন্য বনবিভাগ প্রায় দুইশত বাঙালি মুসলমানকে জয়নাগাছা, বন্দেরিয়চলা, কেজাই গ্রামে নিয়ে আসে।

১৯৬২ সালের তৎকালীন গভর্ণর আজম খান কর্তৃক ঘোষিত ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্পের সার্থক বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে। সরকারি ভাবেই তখন মধুপুর গড়ের ২০,৮৩৭.২৩ একর বনভূমি নিয়ে মধুপুর জাতীয় উদ্যান ঘোষণা দেওয়া হয়।

১৯৮৪ সালে আবার শালবন দখল হয় নতুন নামে নতুন ভাবে। শালবনের পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবেই টেলকীপাড়া ও নয়াপাড়া গ্রামে বনকে ধ্বংস করে মান্দিদের নিজ জমিতে বিমান বাহিনীর জন্য ফায়ারিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মান্দিরা সাথে সাথেই এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিল তাদের নিয়মতানিত্রক প্রতিরোধ। কিন্তু এই প্রতিরোধে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি বন রক্ষার প্রতিষ্ঠান বনবিভাগ বা রাষ্ট্রযন্ত্র।


৩.শালবন ধ্বংস এবং আদিবাসী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নাম রাবার চাষ উন্নয়ন প্রকল্প, উডলট প্রকল্প....

আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (Asian Development Bank-ADB) অর্থায়নে দ্বিতীয় রাবার চাষ উন্নয়ন প্রকল্প মধুপুর শালবনে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। শালবনের বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থাকে (Ecological Condition) বিবেচনা না করেই সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক স্বার্থে অবৈজ্ঞানিক ও জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) বিধ্বংসী এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই রাবার চাষ প্রকল্পের জন্য ১৫০০০ একর জমি প্রকল্প আওতাধীন ধরা হলেও বনের বাসিন্দাদের বিরোধীতার মুখে ৭০০০একর জমিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। আর এই ৭০০০ একর জমিও দখল করা হয় সেই পুরনো কায়দায় অর্থাৎ মান্দিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। রাবারের মনোকালচারের জন্য ৭০০০ একর জমি থেকে পুরো শালবন কেটে ধ্বংস করা হয়। মাটি থেকে সমূলে উপড়ে ফেলা হয় শালগাছের কপিছ (Sal coppices), যা ঐ এলাকায় ভবিষ্যতে শালবন সৃষ্টির প্রাকৃতিক সম্ভাবনাকেও স্থায়ী ভাবে ধ্বংস করে দেয়। পরে অবশ্য স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে পরিবেশবাদীরা এ ব্যাপারে সোচ্চার হলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্প বন্ধে বাধ্য হলেও শালবনের যে মারাত্বক ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়।

রাবার চাষ প্রকল্পের দুই বছর না যেতেই আসে পাঁচ বছর মেয়াদী (১৯৮৯-১৯৯৫) থানা বনায়ন ও নার্সারী উন্নয়ন প্রকল্প, যা সোস্যাল ফরেষ্ট্রি (Social Forestry) নামে পরিচিত। এবার সেই একই আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (Asian Development Bank-ADB) ৪৬.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প ব্যয়ের ১১.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয় শালবন এলাকায় উডলটের পেছনে। মধুপুরের শালবনে এই উডলট প্রকল্পে শতশত একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেওয়া হয়। উডলটের ব্ল­ক তৈরীর জন্য দখলকৃত জমির কপিছ সহ সমস্ত শালগাছ এবং হাজার হাজার প্রজাতির মূল্যবান ঔষধি গাছ সমূলে বিনষ্ট করা হয়। সেখানে লাগানো হয় Eucalyptus spp., Dalbergia sissoo, Leucaena leucocephala, Swietenia macrophylla এবং Cedra toona ইত্যাদি বিদেশি গাছ। উলে­খ্য যে এসমস্ত গাছ সাধারনত মরু (Barren) এলাকায় বনায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়। অথচ আমাদের এখানে হাজার হাজার বছরের পুরোনো প্রাকৃতিক শালবন ধ্বংস করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রেসক্রিপশনে এইসমস্ত গাছ লাগনো হয়েছে। আর এই সমস্ত আয়োজনই যে শালবনকে ধ্বংস এবং শালবনের আদিবাসী কোচ, মান্দি, বর্মণদের বিপন্ন থেকে বিপন্নতর করে দেওয়ার দেশীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তা বলাই বাহুল্য।


৪.শালবন ধ্বংস এবং আদিবাসী উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার নাম ইকোপার্ক প্রকল্প...

৯৭.৩ মিলিয়ন টাকার মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের (Modhupur National Park Development Project) আওতায় ফরেষ্ট কনজারভেশন ও ইকোটুরিজম স্কীমের সরকারী অনুমোদন লাভ করে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি, পশু-পাখি ও বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল নির্মাণের ভালো ভালো বুলি আওড়ে মধুপুর গড়ের প্রায় ৩ হাজার একর বনভূমি ঘিরে ৭ফুট উচ্চতার ৬১ হাজার ফুট ইটের দেয়াল এবং ভেতরে ১০টি পিকনিক স্পট, ২টি ওয়াচ টাওয়ার, ২টি কালভার্ট, ৩টি কটেজ, জলাধার সহ লেক ৯টি, রেষ্ট হাউজ ৬টি, রাস্তা নির্মাণ ৬টি, বন কর্মীদের ৬টি ব্যারাক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি জালাবাদা, সাধুপাড়া, বেদুরিয়া, কাঁকড়াগুনি, গায়রা গ্রাম গুলোতে দেয়াল নির্মাণের জন্য বনকর্মীরা জড়িপ কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত সেখানকার আদিবাসীরা এই দেয়াল নির্মাণের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতো না। অথচ এই প্রকল্পাধীন ভূমিতেই রয়েছে হাজার হাজার কোচ, মান্দিদের বসবাস। ইকোপার্কের নামে কোচ, মান্দিদের উচ্ছেদের এটা যে পুরনো উদ্দেশ্যরই নব্য একটি প্রক্রিয়া তা আর বুঝতে বাকি থাকেনা আদিবাসীদের। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে মুক্তাগাছা থানার বিজয়পুর ও সাতারিয়া এলাকায় মান্দি গ্রাম গুলোতে স্থানীয় মান্দিদের তীব্র প্রতিবাদের মুখেও বনবিভাগ প্রথম দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করে। মান্দি, কোচ, বর্মণেরা জানে এই ইকোপার্কের দেয়াল নির্মাণের ভয়াবহতা কত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে তাদের জীবনাচারে। সংঘবদ্ধ হতে থাকে আদিবাসীরা। বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে তাদের দাবিসমূহ বিভিন্ন ভাবে সরকারের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেন। আদিবাসীদের আন্দোলনের চাপে তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ ২০০৩ সালের ৪ জুলাই দোখলায় আদিবাসী নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেন। আদিবাসীরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। অফলপ্রসু এক আলোচনার পর সরকারের পক্ষ থেকে আদিবাসী নেতৃবৃন্দদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যে কমিটি ইকোপার্ক সংক্রান্ত উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রিপোর্ট পেশ করবে। মূলত এই প্রস্তাব ছিল সরকারের পক্ষ থেকে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনকে বানচাল করে দেওয়ার একটা পাঁয়তারা। এই প্রস্তাব পেশ করেই তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে কোন কিছু না বলে চলে যান। পরবর্তীতে বনবিভাগ সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক যারা দীর্ঘদিন ধরে মান্দি, কোচ, বর্মণদের নিয়ে ইকোপার্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন সেই সব প্রকৃত নেতাদের বাদ দিয়ে খ্রিস্ট্রীয় মিশন প্রধান ও কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গের সমন্বেয় পর্যালোচনা কমিটি গঠনের পরিবর্তে মূলত ইকোপার্ক প্রকল্প সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। সরকারের তৈরীকৃত বিশ্বাসঘাতক এই দালাল শ্রেণী এরপর থেকে ইকোপার্কের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য কিছু অকার্যকর মিটিং-সমাবেশের আয়োজন করতে থাকেন। সংগ্রামরত আদিবাসীরা এই চিহ্নিত দালালদের কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে চালিয়ে যেতে থাকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, হা.বিমাকে রক্ষা করার সংগ্রাম। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে গায়রাতে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় ৩ জানুয়ারি ২০০৪ সালে ইকোপার্ক বিরোধী মিছিলের। সেই ঘোষণার প্রেক্ষিতেই ৩ জানুয়ারি -০৪ গায়রা গ্রামে সাধুপাড়া, কাকড়াগুনি, জয়নাগাছা, জালাবাদা, বিজয়পুর, সাতারিয়া সহ আশেপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষ নিজেদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয়। খা সাংমা খা মারাক-ধ্বণিতে মুখর হয়ে উঠে পুরো শালবন এলাকা। এদিকে সমাবেশ ও মিছিলের খবর পেয়ে সকাল থেকেই সেখানে সরকারের পক্ষথেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও অস্ত্রধারী বনরক্ষীদের এমনকি ঠিকাদারের ভাড়াটে লোকদেরও মোতায়ন করে রাখা হয়েছিল। সমাবেশ শেষে দুপুর বারোটার দিকে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলটি কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরপরই পুলিশ ও বনরক্ষীদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু হলে ঘটনা স্থলেই নিহত হন জয়নাগাছা গ্রামের বিশ বছরের যুবক পীরেন স্নাল; গুলিবর্ষণে মারাত্মক আহত হন রবীন সাংমা, উৎপল নকরেক, এপ্রিল সিমসাং, পঞ্চরাজ ঘাগ্রা, রহিলা সিমসাং, শ্যামল সাংমা, রিতা নকরেক সহ প্রায় ২৫জন আদিবাসী শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষ। এই ঘটনার পরপরই আদিবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। মাসব্যাপী চলে তাদের তুমুল বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ। এদিকে বনবিভাগ বা সরকার শুধু হত্যা ও আহত করেই থেমে থাকেনি। ৪ জানুয়ারি রাতেই নিহত পীরেন স্নাল ও গুলিতে আহত উৎপল নকরেক, জর্জ নকরেক, শ্যামল সাংমা, মৃদুল সাংমা, হ্যারিসন সাংমা, বিনিয়ান নকরেক সহ অজ্ঞাত প্রায় ছয়শত জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে মধুপুর থানার হাবিলদার বাদী হয়ে। এভাবেই বনবিভাগ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করে। শুধুমাত্র জুন ২০০৩ - জুলাই ২০০৪ পর্যন্তই আদিবাসী নেতৃবৃন্দসহ নিরীহ অনেকের নামে বনবিভাগ বা সরকার মামলা দায়ের করে মোট একুশটি। এই একুশটি মামলার সবকটিতেই যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন অজয় মৃ, প্রশান্ত মানখিন, পঞ্জরাজ ঘাগ্রা, মালতি নকরেক, স্বপন নকরেক, নেরি দালবত, মাইকেল নকরেক, চলেশ রিছিল প্রমুখ। আর পীরেন হত্যার পর আদিবাসীদের পক্ষ থেকে যে মামলা দয়ের করা হয়েছিল তা উপযুক্ত তথ্য-প্রমান নেই এই অজুহাত দেখিয়ে খারিজ করে দেয় ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত; অথচ গুলিতে গুরুতর আহত অনেকেই হুইল চেয়ারে করে আদালতে গিয়ে সাক্ষী দিয়ে এসেছিলেন। শুধু তাই নয়,পীরেন স্নাল নিহত হওয়ার পরপরই বনবিভাগ ঘটনার দায়ভার এড়াতে রাতের অন্ধকারে শালবনের বিপুল সংখ্যক গাছ কেটে সরিয়ে নেয়, আর পরবর্তীতে গাছ চুরির মামলা ঠুকে দেয় নিরীহ আদিবাসীদের নামে। এই হচ্ছে বনবিভাগ বা রাষ্ট্র কর্তৃক জীববৈচিত্র্য রক্ষার নমুনা।


৫.খা সাংমা, খা মারাক...

বনবিভিাগ ও রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে এযাবতকালে যতগুলো পরিকল্পনা-প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার কোনটাই যে শালবনকে, শালবনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার জন্য নেওয়া হয়নি বরং সেখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদের মাধ্যমে শালবনের সম্পদ লুট-পাট করার তা অতি স্পষ্ট। যে বনবিভাগ বনরক্ষার (?) মহান ব্রতে (!) নিয়োজিত সেই বনবিভাগের কর্মকর্তারা নিজেরাই কালোবাজারিদের সাথে আতাঁত করে শালবনের সম্পদ পাচার করে আর আদিবাসীদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে চলে। টেলকী গ্রামের এক সিরিন নকরেকের বিরুদ্ধেই বনবিভাগ মামলা দায়ের করেছে প্রায় অর্ধশতকের মতন। বনের গাছ চুরির অভিযোগে সিরিন নকরেক জেলে থাকাকালীন সময়েও তার বিরুদ্ধে গাছ চুরির নতুন নতুন মামলা হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, জেলে থাকাকলীন সময়েও একজন লোক কিভাবে বনের গাছ চুরি করতে পারেন ? এর সদুত্তর বনের বাসিন্দারা কখনো পায়নি বনবিভাগের কাছে বা রাষ্ট্রের কোন প্রশাসন যন্ত্রের কাছে। তারপরেও বনের বাসিন্দারা বারবার বনকর্মকর্তাদের গাছ পাচার বন্ধ করতে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন শালবনের সম্পদ রক্ষা করতে। আর এর জন্য ১০ এপ্রিল ১৯৯৬ সালে জয়নাগাছা গ্রামের বিহেন নকরেককে দিনেদুপুরে জীবন দিতে হয়েছিল বনরক্ষীর গুলিতে। বিহেনের অপরাধ ছিলো ঘটনার দিন বনের ভেতর পাতা কুড়াতে গেলে সে বনবিভাগের গাছ চুরি দেখে ফেলে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এরপর উল্টো বনবিভাগের দাযেরকৃত গাছ চুরির মিথ্যা মামলায় আদালত রায় দেয়, বিহেনকে গুলি করা বৈধ হয়েছে কারন সে বনের গাছ চুরি করছিলো। অথচ বন আইনে গাছ চুরি করলেও কাউকে পিছন থেকে গুলি করার নিয়ম নেই। এই হচ্ছে শালবন ও বনের আদিবাসীদের উপর বনবিভাগ বা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রহসনের বাস্তব প্রতিচিত্র। কিন্তু শালবনের যারা আদিবাসিন্দা, শালবন যাদের জীবন-ধর্ম-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সেই মান্দি, কোচ, বর্মণেরা কোনভাবেই এই শালবনকে ধ্বংস হতে দিতে পারে না, নিজেদের অস্তিত্ব, জীবন, সংস্কৃতিকে কোন ভাবেই বিলীন হতে দিতে পারে না। আর সেজন্যেই যুগে যুগে তারা লড়াই করে এসেছে সমস্ত ষড়যন্ত্র, কালো আইন, নির্যাতন-নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা, উচ্ছেদ আর দেয়াল নির্মাণের বিরুদ্ধে। পীরেন স্নাল সেই সংগ্রামী চেতনাকে ধারন করেই নিজ হা.বিমা ও নিজ জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন নিজ হা.বিমার বুকে। হা.বিমার বুক থেকে পীরেন স্নালের রক্তের যে আহবান ধ্বনিত-প্রতিধ্বণিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত সেই আহবানকে কখনো উপেক্ষা করতে পারে না হা.বিমার সন্তানেরা। বিহেন নকরেক, গীদিতা রেমা ও বীর পীরেনের সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করেই হা.বিমার সন্তানেরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, শালবন তথা হা.বিমাকে রক্ষার জন্য লড়ে যাবে নিরন্তর।

তথ্যসূত্র ঃ
১.Bangladesh Land, Forest and Forest People Editor-Philip Gain Published by- SHED, Dhaka.
২.সংহতি ২০০৪।।সম্পাদক-সঞ্জীব দ্রং।। প্রকাশনায়-বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; বনানী, ঢাকা।
৩. বিপন্ন ভূমিজ, অস্তিত্বের সংকটে আদিবাসী সমাজ, বাংলাদেশ ও পূবৃভারতের প্রতিচিত্র।। সম্পাদনা- মেসবাহ কামাল,আরিফাতুল কিবরিয়া।। আরডিসি, ২০০৩ ,ঢাকা।।
৪.মান্দিরাংনি চিঠি ।। সম্পাদক-প্রশান্ত চিরান।। ত্রয়োদশ বর্ষ-৫ম সংখ্যা,অক্টোবর ২০০৩।। প্রকাশনায়- ফারাকা কালচারাল এসোসিয়েশন।
৫.আচিক।। সম্পাদক-অর্পন যেত্রা।। বর্ষ-২, সংখ্যা-২, ফেব্রুয়ারি-মার্চ-২০০৪।। ঢাকা।
৬. খোলা চোখ।। সম্পাদক- খোকন রিছিল।। প্রকাশনায়- প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ।। ৪৩৪ জগন্নাথ হল , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।। আগস্ট ২০০৩, ঢাকা।
৭.দৈনিক প্রথম আলো (৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১৩, ২৩, ২৭ জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যা), ঢাকা।
৮. দৈনিক ভোরের কাগজ (২৭ জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যা), ঢাকা।
৯.দৈনিক জনকন্ঠ (২৫, ২৭ জানুয়ারি২০০৪ সংখ্যা), ঢাকা।
১০.সাক্ষাতকার-আলবার্ট মানখিন, ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের নেতা।